বাংলাদেশি মালিকানাধীন পেট্রোম্যাক্স কিনে নিয়েছে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক বৈশ্বিক কোম্পানি এসএইচভি এনার্জি।
দেশের তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজির বাজারে বড় বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে নেদারল্যান্ডস তথা ডাচ কোম্পানি পেট্রোম্যাক্স এনার্জি। এদেশীয় কোম্পানি পেট্রোম্যাক্স এলপিজি কিনে বাংলাদেশে এলপিজির বাজারে পা রাখছে ১২৫ বছরের পুরোনো ডাচ কোম্পানিটি। গত ২২ আগস্ট পেট্রোম্যাক্স এনার্জির হাতে মালিকানা তুলে দিয়েছে পেট্রোম্যাক্স কর্তৃপক্ষ। প্রায় ১০ কোটি ডলার বা প্রায় হাজার কোটি টাকায় এলপিজি ব্যবসার মালিকানা হাতবদল হয়েছে দুই কোম্পানির মধ্যে। সংশ্লিষ্ট একাধিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৮৯৬ সালে আটজন ডাচ কয়লা ব্যবসায়ী মিলে শুরু করে জ্বালানি খাতে এসএইচভির ব্যবসা। কোম্পানিটির এটিই প্রথম বাংলাদেশে বিনিয়োগ। এর মাধ্যমে কোম্পানিটি এ দেশের জ্বালানির খাতের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রথম হলেও যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়ার অনেক দেশেই এলপিজির বাজারে শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে ডাচ কোম্পানিটি। কোম্পানিটির ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এটির বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ছিল ২ হাজার কোটি ইউরো। প্রতি ইউরোর বিনিময়মূল্য ৯৫ টাকা ধরে হিসাব করলে বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। বিশ্বের ৭৩টি দেশে কোম্পানিটির কার্যক্রম রয়েছে।
দেশে পেট্রোম্যাক্স এলপিজি ব্যবসা শুরু করে ২০১৮ সালে। মোংলা ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে কোম্পানিটির দুটি কারখানা রয়েছে। এ ছাড়া এলপিজির সিলিন্ডার তৈরির জন্য টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে রয়েছে আলাদা আরেকটি কারখানা। কোম্পানিটির বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা দেড় লাখ মেট্রিক টন। সর্বশেষ ২০২১ সালে কোম্পানিটি প্রায় ৬৫০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ও এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়াব) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৫৬টি কোম্পানি এলপিজি ব্যবসার জন্য সরকারের কাছ থেকে নিবন্ধন নিয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি কোম্পানি সক্রিয়। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলারের দাম ৯৫ টাকা ধরে)। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সর্বশেষ গত বছর ১২ লাখ টন এলপিজি সরবরাহ করা হয় বাজারে। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশের বেশি সরবরাহ করে বেসরকারি খাত। আর দেড় শতাংশ চাহিদা পূরণ করেছে সরকারি কোম্পানি।
রাষ্ট্রায়ত্ত এলপি গ্যাস কোম্পানির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১০ বছর ধরে দেশে এলপিজির ব্যবহার প্রতিবছর গড়ে সাড়ে ৩৫ শতাংশ করে বেড়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৪১ সাল নাগাদ দেশে এলপিজির বার্ষিক চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ৭০ লাখ টনে। তাই বাড়তি চাহিদা পূরণে সরকারিভাবেও এলপিজি আমদানির পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে এ খাতের বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সংগঠন লোয়াব বলছে, সরকারি প্রক্ষেপণে চাহিদা একটু বেশি ধরা হয়েছে। আগামী কয়েক বছর ২০ শতাংশ হারে চাহিদা বাড়তে পারে। ২০২৫ সালে চাহিদা হতে পারে ৩০ লাখ টন।
আমরা বেশ কিছুদিন ধরে এ ব্যবসা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম। এ জন্য সম্ভাব্য ক্রেতা খুঁজছিলাম।ফরিদুল আলম, ব্যবস্থাপনা পরিচাল, পেট্রোম্যাক্স
বাংলাদেশে এলপিজির বাজার বড় হতে থাকায় এ খাতের বিশ্ববাজারের শীর্ষস্থানীয় ডাচ কোম্পানি পেট্রোম্যাক্স এনার্জি এ দেশে নতুন করে বিনিয়োগে এসেছে। তবে বাজার বড় হলেও এ খাতে বেড়েছে প্রতিযোগিতাও। যে হারে কোম্পানি বাড়ছে একপর্যায়ে গিয়ে তাতে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা দেখে দিতে পারে, এমন আশঙ্কায় এ ব্যবসা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে পেট্রোম্যাক্স।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুল আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বেশ কিছুদিন ধরে এ ব্যবসা থেকে নিজেদের
গুটিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম। এ জন্য সম্ভাব্য ক্রেতা খুঁজছিলাম। আর এ সময় এসএইচভির কাছ থেকে ভালো একটি প্রস্তাব
পাই। তিন মাস আলাপ-আলোচনার পর তাদের কাছেই কোম্পানির মালিকানা বিক্রি করে দিয়েছি। বৈশ্বিক এ কোম্পানিটির কাছে আমাদের ব্যবসা স্থানান্তর করতে পেরে আমরা আনন্দিত। আশা করছি, দেশের এলপিজির বাজারে তারা ভালো কিছু করবে।’
পেট্রোম্যাক্স সূত্রে জানা যায়, মালিকানা বিক্রি হয়ে গেলেও কোম্পানির কর্মী থেকে শুরু করে কার্যালয় কোনো কিছুতেই কোনো পরিবর্তন আসবে না। সবকিছু আগের মতোই থাকবে, শুধু মালিকানা বদল হবে। এত দিন পেট্রোম্যাক্স এলপিজির মালিকানায় ছিল এদেশীয় কোম্পানি ইয়ুথ গ্রুপ। এ গ্রুপের বস্ত্র খাতের ব্যবসার পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানি শাহজিবাজার পাওয়ারের মালিকানায় রয়েছে।
ডাচ কোম্পানি পেট্রোম্যাক্স এনার্জির পক্ষ থেকে পেট্রোম্যাক্স কিনে নেওয়ার বৈদেশিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ছিল বহুজাতিক হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন বা এইচএসবিসি বাংলাদেশ। এক বিজ্ঞপ্তিতে এইচএসবিসি বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও মাহবুব উর রহমান বলেন, ‘অধিগ্রহণ চুক্তিটি সম্পন্ন করতে পেরে আমরা খুবই উচ্ছ্বসিত। এসএইচভির মতো একটি বড় বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের একটি কোম্পানি অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হলো—বৈশ্বিক পর্যায়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় হচ্ছে।’
এদিকে পেট্রোম্যাক্স এনার্জির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিষ্ঠানটির সিইও ব্রাম গ্রেভার বলেন, ‘বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করতে পেরে আমরা খুবই উচ্ছ্বসিত। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ হবে আমাদের অন্যতম বাজার।’
বিপিসি ও লোয়াবের তথ্য বলছে, দেশে ২০০০ সালে প্রথম এলপিজির ব্যবসা শুরু করে বসুন্ধরা। বাজারে এখনো শীর্ষে রয়েছে কোম্পানিটি। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ওমেরা। এ ছাড়া শীর্ষ সরবরাহকারীদের মধ্যে আছে ওরিয়ন, যমুনা, নাভানার মতো ব্র্যান্ড। দুই বছর ধরে বাড়তে শুরু করেছে ফ্রেশ এলপিজির সরবরাহও। ২০১০ সালে বাসাবাড়িতে নতুন গ্যাস-সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে বাড়তে শুরু করে এলপিজির ব্যবহার।