বৈশ্বিক ওষুধশিল্পে যে পালাবদল ঘটতে চলেছে

বিশ্ব অর্থনীতির পালাবদলে ভারতের লাভ হচ্ছে। সেই সব বৈশ্বিক ওষুধ কোম্পানি চীনের সরবরাহকারীদের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর চেষ্টা করছে, যারা এত দিন বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাত ও প্রাথমিক পর্যায়ের ওষুধ উৎপাদন করত। তাদের এই সিদ্ধান্তে ভারতের লাভ হচ্ছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সংবাদে বলা হয়েছে, ২০ বছর ধরে বিশ্বের ওষুধ কোম্পানিগুলোর গবেষণা ও উৎপাদনের প্রিয় গন্তব্য ছিল চীন। খুব কম খরচে ও দ্রুততার সঙ্গে সেবা দিতে পারত বলে কোম্পানিগুলো চীনের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামানায় বাণিজ্যযুদ্ধ, এমনকি কোভিডের সময় সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমা ওষুধ কোম্পানিগুলোর এই নির্ভরতা এত দিন একরকম অটুট ছিল। কিন্তু সম্প্রতি বেইজিংয়ের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক সম্পর্কের উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক পশ্চিমা কোম্পানি চীনের সরবরাহব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাসের চেষ্টা করছে। তারা চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার চেষ্টা করছে।

এ পরিস্থিতিতে পশ্চিমা জৈব প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট বা ওষুধের উপকরণ তৈরিতে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর কথা ভাবছে, সেই সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যও ভারতকে বেছে নেওয়ার চিন্তা করছে তারা।

খাত–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীন কত সস্তায় বা দ্রুততার সঙ্গে এই পণ্য দিতে পারবে, সেটা এখন আর বিবেচ্য বিষয় নয়। তাঁদের মোদ্দাকথা, চীনের কোম্পানিগুলোকে কাজ দেওয়া যাবে না।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জৈব প্রযুক্তি কোম্পানি গ্লাইসেন্ড থেরাপিউটিকসের প্রতিষ্ঠাতা আশিস নিমগাওঁকার রয়টার্সকে বলেন, গত কয়েক বছরের ঘটনাপ্রবাহে বলতে হয়, ‘চীন আর এখন আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য নয়।’ তাঁর কোম্পানি টাইপ–২ ডায়াবেটিস ও স্থূলতার ওষুধের প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে।

নিমগাওঁকার বলেন, আগামী দিনে গ্লাইসেন্ড ওষুধের উপকরণ তৈরি বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রক্রিয়া শুরু করলে চীনাদের পরিবর্তে ভারতীয় কনট্র্যাক্ট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং অর্গানাইজেশনকে (সিডিএমও) প্রাধান্য দেওয়া হবে।

এদিকে ভারতের সিডিএমওর চার বৃহত্তম সদস্য কোম্পানি অর্থাৎ অরেগেন লাইফ সায়েন্সেস, প্রাইমাল ফার্মা সলিউশনস, সিনজেন ও সাই লাইফ সায়েন্সেস বলেছে, চলতি বছর তাদের বিষয়ে পশ্চিমা ওষুধ কোম্পানিগুলোর আগ্রহ বেড়েছে।

সাই লাইফ সায়েন্সেস জানিয়েছে, চলতি বছর তাদের বিক্রি ২০-৩০ শতাংশ বেড়েছে, যদিও তারা ঠিক কতটা মুনাফা করেছে, সে বিষয়ে কিছু জানায়নি। অন্যান্য কোম্পানি জানিয়েছে, সাম্প্রতিক কয়েকটি প্রান্তিকে তাদের মুনাফা বেশ ভালোই বেড়েছে।

পশ্চিমা ওষুধ কোম্পানিগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা রয়টার্সকে বলেছেন, অনেক কোম্পানি এখন ভারতকে দ্বিতীয় উৎস হিসেবে রাখতে চায়। অন্যরা এখন চীন ছাড়তে চাইছে এবং এমনকি সরবরাহব্যবস্থা ভারতভিত্তিক করারও অনুরোধ করছে।

ওষুধের বার্ষিক বাজার ৪২ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারের। পালাবদলের এই সময়ে ভারতীয় কোম্পানিগুলো চেষ্টা করছে, এই বাজারে যতটা সম্ভব ভাগ বসানো। তবে বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ভারতের ওষুধ কোম্পানিগুলো এখনই এই পালাবদলের পূর্ণাঙ্গ সুযোগ নিতে পারবে না।

চীনের কোম্পানিগুলোর এ খাতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে। বিশেষ করে বায়োলজিক ড্রাগ বা প্রাণিসত্ত্বা থেকে ওষুধ তৈরিতে তাদের দক্ষতা সারা পৃথিবীতেই স্বীকৃত। সাধারণ ওষুধের তুলনায় এসব ওষুধের অনুমোদনপ্রক্রিয়া আরও কঠিন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা এফডিএ ভারতে তৈরি চোখের ড্রপ নিয়ে যে সতর্কবার্তা দিয়েছে, তাতে বোঝা যায়, উচ্চমান বজায় রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

তা সত্ত্বেও ভারতের সিডিএমও শিল্পের প্রবৃদ্ধি হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর ভারতের সিডিএমও খাতের রাজস্ব আয় হতে পারে ১৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৫৬০ কোটি ডলার। সেই তুলনায় চীনের সিডিএমও খাতের আয় হতে পারে ২৭ দশমিক ১ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৭১০ কোটি ডলার। আগামী পাঁচ বছরে ভারতের সিডিএমও খাতে প্রবৃদ্ধির হার চীনকে ছাড়িয়ে যাবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এই সময় ভারতের প্রবৃদ্ধি হবে ১১ শতাংশ।

রয়টার্সের সংবাদে বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে ওষুধ খাতের যে পালাবদল ঘটছে এবং দাঁড়িপাল্লাটা যে ভারতের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে, তা পরিষ্কার। জৈব প্রযুক্তি খাতের স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো এখন চীনের সঙ্গে ভারতের কথাও ভাবছে। এতেই বোঝা যায়, বৈশ্বিক ওষুধ খাতের গতিপ্রকৃতি কেমন হচ্ছে।