গুগলকে যেন তাদের জনপ্রিয় ক্রোম ব্রাউজার বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য একজন বিচারকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন বিচার বিভাগের আইনজীবীরা। বাজারে একচেটিয়া ব্যবসা করার ক্ষমতা সীমিত করে প্রতিযোগিতা বাড়াতে এই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন এই আইনজীবীরা। বিচারক এর পক্ষে রায় দিলে গুগলের ব্যবসায় বিশাল পরিবর্তন আসবে।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, গুগল ভেঙে দেওয়ার জন্য গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ তাদের সুপারিশ মার্কিন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের বিচারক অমিত মেহতার কাছে হস্তান্তর করেছে। তিনি আগামী বছর পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন। অনলাইন সার্চ বা তথ্য খুঁজে পাওয়ার কার্যক্রমে বর্তমানে গুগলের একচেটিয়া ক্ষমতা ও ব্যবসা রয়েছে।
ওয়েডবুশ সিকিউরিটিজের বিশ্লেষক ড্যান আইভস বলছেন, এটি গুগলের জন্য ‘বিশাল আঘাত’ হিসেবে আসবে।
গুগল তথ্য খুঁজে দেওয়া বা সার্চের বিনিময়ে কোনো অর্থ নেয় না। তবে নির্দিষ্ট ভোক্তাকে লক্ষ্য করে বিজ্ঞাপন ও তথ্য প্রচার করে, যেখানে থেকে কোম্পানিটি অর্থ পায়। এর মাধ্যমে বিজ্ঞাপনদাতা অনলাইনে ব্যবসা করতে পারে।
সিরাকুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞাপন বিভাগের অধ্যাপক বেথ ইগান বলেন, আদালত বিচার বিভাগের পক্ষে রায় দিলে তা গুগলের ‘ব্যবসার মডেল বড়ভাবে পরিবর্তন’ করবে।
ক্রোম বিক্রি করে দিলে গুগল তথ্যের একটি বড় ভান্ডার হারাবে। এই তথ্য ব্যবহার করে গুগল তার অ্যালগরিদম উন্নত করে এবং ম্যাপসের মতো সেবা বিক্রি করে। ২০০৮ সালে চালু করার পর ক্রোম ব্রাউজার জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের পেছনে পড়ে গেছে মাইক্রোসফটেন এজ ও অ্যাপলের সাফারি ব্রাউজার।
বেথ ইগান অবশ্য মনে করেন, ক্রোম বিক্রি করতে বাধ্য হলেও গুগল আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না, ক্রোম থেকে বিনিয়োগ উঠিয়ে নিলে একটি কোম্পানি হিসেবে গুগলের মৃত্যু ঘটবে।’ তিনি আরও বলেন, শেষ পর্যন্ত হয়তো ব্যবহারকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বিশ্বজুড়ে ৩০০ কোটি মানুষ ক্রোম ব্যবহার করে। ব্লুমবার্গের এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিক্রি হলে গুগলের দাম দাঁড়াতে পারে কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। কিন্তু যেহেতু এটি আগে কখনো বিক্রি হয়নি, তাই ঠিক কত দামে ক্রোম বিক্রি হতে পারে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলা খুবই কঠিন।
২০১৬ সালে একটি চীনা কোম্পানি নরওয়ের অপেরা সফটওয়্যার এএসএর কাছ থেকে একটি ইন্টারনেট ব্রাউজার কিনেছিল। তখন এটির দাম পড়েছিল ৬০ কোটি ডলার। কিন্তু সে সময়ে এটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৩৫ কোটি।
ইমার্কেটারের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক ইভলিন মিশেল-উলফ মনে করেন, ক্রোম কেনার জন্য খুব বেশি ক্রেতা পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, ‘এটা খুবই সম্ভব যে ক্রোম কিনতে আর্থিকভাবে সক্ষম এমন যেকোনো কোম্পানিই এখন প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা–সংক্রান্ত বিভাগের নজরদারিতে আছে। আমাকে যদি ধারণা করতে হয়, তাহলে আমি বলব, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক কোম্পানিগুলোর দিকে তাকান।’
ওপেনএআইয়ের মতো প্রতিষ্ঠান ক্রোম কিনে নিলে তা প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি উদ্বেগের বিষয় হবে। ক্রেতার তালিকায় থাকতে পারে ইলন মাস্কের এআই স্টার্টআপ। তাঁর হাতে অনেক অর্থ রয়েছে, আর নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠাতার কারণে এই চুক্তি তিনি সহজে অনুমোদন করাতে পারবেন।
বিশ্লেষকেরা একমত যে ব্যবহারকারীরা ক্রোমের ব্যবহার অব্যাহত রাখবেন, যিনিই এর মালিক হোন না কেন। শর্ত একটাই, এটির মান বজায় রাখতে হবে। ইভলিন মিশেল-উলফ বলেন, ক্রোম তার জনপ্রিয় ফিচারগুলো অপরিবর্তিত ও উদ্ভাবন অব্যাহত রাখলে ব্যবহারকারীরা একে ছেড়ে যাবেন না। তাঁর মতে, ‘সার্চের ক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি প্রথমে আসে। বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতা হলো পরের ব্যাপার।’
অনেকেই এ ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেন যে বিচারক মেহতা বিচার বিভাগের সব পরামর্শে কান দেবেন। সিএফআরএ বিশ্লেষক অ্যাঞ্জেলো জিনো বিচার বিভাগের পদক্ষেপগুলোকে কঠিন বলে মনে করেন। তাঁর মতে, ‘আদালত এগুলো চাপিয়ে দেবেন, সেই সম্ভাবনা কম।’
গুগল ভেঙে দেওয়ার ধারণা থেকে বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা পিছিয়ে যাবেন কি না, সে বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের মনোভাব গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। গত অক্টোবরে ট্রাম্প এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে তিনি গুগল ভেঙে দেওয়ার বিপক্ষে। কারণ, তাঁর বিশ্বাস যে এই পদক্ষেপ বিশ্বের মার্কিন স্বার্থ ক্ষুণ্ন করতে পারে। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘চীন গুগল নিয়ে ভীত’ এবং গুগল ভেঙে দেওয়া হলে তা কোম্পানির ক্ষতি করবে।
তবে একই সঙ্গে তিনি গুগলকে এই বলে অভিযুক্ত করেছিলেন যে গুগল রক্ষণশীলদের ব্যাপারে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছে।