ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

বিদেশি পণ্যে আরও শুল্ক, কর হ্রাস, জ্বালানি—কী থাকছে ট্রাম্পের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায়

আবারও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশেই পণ্য উৎপাদনের জন্য নানা রকম ব্যবস্থা নেবেন, উৎপাদন খরচ কমাবেন, রাজকোষ ভরিয়ে তুলতে আমদানি শুল্ক বাড়াবেন এবং অন্যান্য দেশের ওপর চাপ বাড়িয়ে চলবেন। কিন্তু বাস্তবতা সম্ভবত এতটা সোজাসাপটা নয়।

আগামী নভেম্বর মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে অর্থনীতিবিদেরা সতর্ক করে বলেছেন যে ট্রাম্পের নীতিমালা পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিতে পারে। একই সঙ্গে তা পুরো বিশ্ববাণিজ্যকেই ওলট–পালট করতে পারে। তবে এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য উৎপাদনব্যবস্থা কতটা সুবিধা পাবে, সে বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট নয়।

বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের লক্ষ্য হলো শুল্কের মাধ্যমে শত শত কোটি ডলার আয় করা। তাঁর মতে, চীন ‘আমাদের শেষ করে দিচ্ছে’, তাই চীনের মতো দেশগুলোকে তিনি লক্ষ্যবস্তু বানাতে চান। পাশাপাশি তিনি মার্কিন কোম্পানিগুলোকে চাপ দেবেন, যাতে তারা তাদের উৎপাদন কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনে।

সেপ্টেম্বর মাসে তিনি কমলা হ্যারিসের সঙ্গে যে বিতর্ক করেছেন, তাতে ট্রাম্প বলেছেন, ‘দীর্ঘ ৭৫ বছর পর অন্য দেশগুলো শেষ পর্যন্ত আমাদের পাওনা বুঝিয়ে দেবে। কারণ, আমরা বিশ্বের জন্য অনেক কিছুই করেছি।’ গত সপ্তাহে মিশিগানে এক জনসভায় তিনি বলেন, ‘আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর শব্দ হলো শুল্ক।’

সাবেক এই প্রেসিডেন্ট যেকোনো আমদানির ওপর ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করতে চান। আর চীনের পণ্যের ওপর তিনি চান ৬০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতে। অতি সম্প্রতি তিনি বলেছেন, মেক্সিকোতে তৈরি গাড়ির ওপর ২০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার ইচ্ছা আছে তাঁর।

ট্রাম্প মনে করেন, বিদেশি সরকারগুলো শুল্ক পরিশোধ করে। তবে আমদানি শুল্ক পরিশোধ করে মূলত মার্কিন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সে কারণে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে, ফলে বাড়তে পারে মূল্যস্ফীতি। শুল্ক বাড়ানোর পাশাপাশি ট্রাম্প কর হ্রাসের সুবিধা সম্প্রসারণ করা ও করপোরেট আয়কর আরও কমাতে চাইছেন।

মূল্যবৃদ্ধির শঙ্কা

পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকস বলছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি সব পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন এবং অন্যান্য দেশ যদি একই রকম প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে আগামী বছর মূল্যস্ফীতি বর্তমানের তুলনায় ১ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়তে পারে। আর চীনা পণ্যে বেশি শুল্ক আরোপ করা হলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে।

তবে অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের বার্নার্ড ইয়ারোস ধারণা করছেন, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট থাকার মেয়াদে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ বাড়তে পারে।

সান ডিয়োগোতে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপক কাইল হ্যান্ডলি বলেন, আমদানি করা পণ্য বেশি দামি হয়ে গেলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেই সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়। অল্প দিনের নোটিসে বিভিন্ন পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন করা যাবে বলেও মনে হয় না।

কাইল হ্যান্ডলি বলেন, ‘বেশ কয়েক দশক ধরে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে টেলিভিশন বানাই না।’ তিনি মনে করেন, ভোক্তাদের চাহিদা পূরণ করতে যে বিপুল উৎপাদন কর্মকাণ্ড চালানোর প্রয়োজন, যুক্তরাষ্ট্রের কারখানাগুলোতে সেটা সম্ভব নয়।

ট্রাম্প এর আগে দাবি করেন যে চীন ও অন্যান্য দেশের পণ্যে শুল্ক আরোপ করা হলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে না। তবে কাইল হ্যান্ডলি এই দাবির সঙ্গে একমত নন। আর বিভিন্ন কোম্পানি এএফপিকে বলেছে যে অতিরিক্ত খরচ তারা ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে বাধ্য হবে।

বাণিজ্যে গতি পরিবর্তন

ডোনাল্ড ট্রাম্প যে শুল্কনীতি গ্রহণ করতে চান, তার ফলে মার্কিন–চীন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় ৭০ শতাংশ কমে যেতে পারে। অক্সফোর্ড ইকোনমিকস মনে করে, এর ফলে শত শত কোটি ডলারের ব্যবসা ভিন্ন দেশে চলে যেতে পারে অথবা বৈশ্বিক বাণিজ্য থেকে একেবারে হারিয়ে যেতে পারে।

এ ছাড়া মার্কিন বৈশ্বিক বাণিজ্য কমতে পারে ১০ শতাংশ। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা বাড়বে উত্তর আমেরিকা ও তাদের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি আছে, এমন দেশগুলোর ওপর। অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হলে বার্ষিক ৫০ হাজার কোটি ডলার বাড়তি রাজস্ব আদায় হবে। কিন্তু চীন থেকে ভিন্ন দেশে ব্যবসা চলে গেলে এই রাজস্ব আয় ২০ হাজার কোটি ডলারে নেমে যেতে পারে বলে বার্নার্ড ইয়ারোস মনে করেন।

খাদ্য ও জ্বালানি

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায়ই প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি নির্বাচিত হলে মূল্যস্ফীতি হটাবেন। মূল্যস্ফীতি নিয়ে মার্কিন ভোটারদের উদ্বেগ রয়েছে। রিপাবলিকান এই প্রার্থী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি এক বছরের মধ্যে ভোটারদের জ্বালানি খাতের খরচ অর্ধেকে নামিয়ে আনবেন।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ট্রাম্প যে দেশের মধ্যে তেল ও গ্যাসের উৎপাদন আরও নিয়ন্ত্রণমুক্ত চান, এ কথার মাধ্যমে তা–ই বুঝিয়েছেন। তবে তেলের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে, এমন সম্ভাবনার ব্যাপারে বার্নার্ড ইয়ারোস বেশ সন্দিহান। কারণ, বড় কোম্পানিগুলোই নির্ধারণ করে যে ঠিক কতটা উৎপাদন বাড়ানো হবে। এসব কোম্পানি শেয়ারধারীদের কাছে জবাবদিহি করে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প বিদেশ থেকে কৃষিপণ্যের আমদানি কমিয়ে দেশেই কম খরচে খাদ্য উৎপাদন করতে চান। তবে অর্থনীতিবিদেরা সতর্ক করে বলেছেন যে আমদানি বাধাগ্রস্ত করা হলে অন্যান্য দেশ প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। এর ফলে মার্কিন কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, কারণ দেশটি প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্য রপ্তানি করে।