চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার কারণে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভারত। গত চার বছরে এ কারণে ভারতের ইলেকট্রনিকস পণ্য প্রস্তুতকারকেরা ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার মূল্যের উৎপাদন হারিয়েছে এবং ১ লাখ মানুষ বঞ্চিত হয়েছে চাকরি থেকে। চীনাদের ভিসা দিতে দেরি করা এবং ভারতে চীনা কোম্পানির বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্তের মধ্যে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
ইকোনমিক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, ভারতের ইলেকট্রনিকস পণ্য প্রস্তুতকারকেরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এ ব্যাপারে চিঠি দিয়েছে। এসব চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, এ সময়ে ভারত ১ হাজার কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির সুযোগ হারিয়েছে। এ ছাড়া পণ্য প্রস্তুত করে ভারতীয় কারখানাগুলো এ সময় আরও ২০০ কোটি ডলারের মূল্য সংযোজন করতে পারত।
ইলেকট্রনিকস শিল্পের শীর্ষ নির্বাহীদের দেওয়া তথ্যানুসারে, এ মুহূর্তে চীনাদের করা চার থেকে পাঁচ হাজার ভিসা আবেদন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ফলে ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদন বাড়াতে ভারতীয় বিভিন্ন কোম্পানি যেসব পরিকল্পনা করেছে, তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যেকোনো বিজনেস ভিসা ১০ দিনে নিষ্পত্তি করা হবে, এমন সিদ্ধান্ত থাকার পরও চীনাদের ভিসা আবেদনের পাহাড় জমছে।
ইন্ডিয়া সেলুলার অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস অ্যাসোসিয়েশন (আইসিইএ) এবং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন অব ইনফরমেশন টেকনোলজি (এমএআইটি) কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে যে চীনা নির্বাহীদের ভিসার আবেদন যেন দ্রুত অনুমোদন করা হয়। বর্তমানে চীনাদের ভিসা নিষ্পত্তি করতে এক মাসের বেশি সময় নিচ্ছে দিল্লির কর্তৃপক্ষ।
ভারতীয় নির্বাহীরা বলেন, প্রযুক্তি ও দক্ষতা হস্তান্তর, কারখানা নির্মাণ ও উৎপাদন কার্যক্রম শুরু, দক্ষভাবে কাজ করা ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য চীনাদের প্রয়োজন। এ ছাড়া স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে শিল্প স্থাপনে যেসব চীনা কোম্পানির শীর্ষ নির্বাহীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, তাঁদের ভিসা আবেদনও অনুমোদনের অপেক্ষায় পড়ে রয়েছে।
আইসিইএ তাদের চিঠিতে বলেছে, তাদের মূল্য সংযোজনের যে পরিকল্পনা ছিল, তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যখন মুঠোফোন উৎপাদন–সম্পর্কিত প্রণোদনা কর্মসূচি ২০২০–২১ সালে নেওয়া হলো, তখন এই প্রত্যাশা ছিল যে চীন থেকে সরবরাহ চেইন চলে আসবে। কিন্তু ভিসা জটিলতা ও প্রতিবেশী দেশের বিনিয়োগের ব্যাপারে অধিকতর যাচাই–বাছাই সে প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
এই সমিতির সদস্যদের মধ্যে রয়েছে অ্যাপল, অপো, ভিভো, ডিক্সন টেকনোলজি এবং লাভার মতো শীর্ষ মোবাইল ব্র্যান্ড ও প্রস্তুতকারক কোম্পানি।
আইসিইএ ধারণা করছে যে ভারত ও চীনের মধ্যে যদি স্বাভাবিক বাণিজ্য কর্মকাণ্ড চলত, তাহলে ভারতীয় কোম্পানিগুলো ২২ থেকে ২৩ শতাংশ মূল্য সংযোজন করতে পারত। বর্তমানে এই হার ১৮ শতাংশ। মূল্য সংযোজন বাড়লে ভারতীয় মোবাইল শিল্পে প্রতিবছর অতিরিক্ত ১৫ হাজার কোটি রুপি যোগ হতো।
আইসিইএর চেয়ারম্যান পঙ্কজ মহিন্দ্রু ইকোনমিক টাইমসকে বলেন, একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান হলে শিল্পের উদ্বেগ দূর হবে এবং একই সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থও রক্ষিত হবে। আমরা এ ব্যাপারে সতর্কভাবে আশাবাদী। এই শিল্প বিশেষ কোনো দেশের কথা বলছে না। তবে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে আত্মনির্ভরতা নির্ভর করবে চীনা ভ্যালু চেইনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ওপর।
পঙ্কজ মহিন্দ্রু আরও বলেন, যদিও ভারত বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠে আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে, তারপরও ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও মেক্সিকোর তুলনায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেশটি পিছিয়ে রয়েছে। ওই তিন দেশ চীন থেকে বিনা মূল্যে পুঁজি, প্রযুক্তি ও দক্ষতা পাচ্ছে।
ভারতীয় ইলেকট্রনিকস শিল্পের নির্বাহীরা বলছেন, চীনা নাগরিকেরা ভারতে আসতে রীতিমতো ভয় পাচ্ছেন। তাঁদের আশঙ্কা, তাঁরা গ্রেপ্তার কিংবা জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে পারেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নির্বাহী বলেন, ‘একটি কারখানা স্থাপনে যদি ৫০ জন চীনা প্রকৌশলীর দরকার হয়, তাহলে হয়তোবা ১০ জন ভারতে আসতে আগ্রহী হন।’
এই নির্বাহী আরও বলেন, ২০২০ সাল থেকে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি এতটা খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এবং চীনা কোম্পানিগুলোর যাচাই–বাছাই এতটা বেড়েছে যে এই কোম্পানিগুলো ভারতে নতুন বিনিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে সরবরাহ চেইনে যে উন্নতির আশা করা হয়েছিল, তা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, একটি বড় চীনা কোম্পানি ভারতে একটি কারখানা স্থাপন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, এই কারখানায় অ্যাপলের আইপ্যাড তৈরি করা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোম্পানিটি সেই বিনিয়োগ ভিয়েতনামে সরিয়ে নেয়। ওই কারখানায় প্রতিবছর এখন ৮০০ থেকে ১ হাজার কোটি ডলার মূল্যের আইপ্যাড তৈরি করা হয়।
নির্বাহীরা বলেন, মুঠোফোন উৎপাদন–সম্পর্কিত ভারতীয় প্রণোদনা কর্মসূচিতে যোগ দিতে চীনা কোম্পানিগুলো খুবই সতর্ক। ফলে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে। একজন নির্বাহী বলেন, ‘চীনা কোম্পানিগুলোকে যদি এই কর্মসূচিতে যোগ দিতে নিরস্ত না করা হতো, তাহলে ২০২০ সাল থেকে আমরা আরও ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি ডলারের অতিরিক্ত রপ্তানি করতে পারতাম।’
গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের মে মাসে প্রকাশ করা পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ভারত ৮ হাজার ৯৮০ কোটি ডলার মূল্যের ইলেকট্রনিকস, টেলিকম ও ইলেকট্রিক পণ্য আমদানি করেছে। এই আমদানির ৪৪ শতাংশই এসেছে চীন থেকে। আর হংকং থেকে আনা আমদানি বিবেচনায় নিলে এই হার দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশে।
২০০৭ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ভারত প্রতিবছর এসব পণ্য আমদানির জন্য ৭৯০ কোটি ডলার খরচ করত। ২০২০ থেকে ২০২২ সময়ে এসব পণ্যের আমদানি অনেকটা বেড়ে ২ হাজার ৩৩০ কোটি ডলারে পৌঁছায়।