যেসব কারণে জড়সড় চীনের অর্থনীতি

অর্থনৈতিক অবস্থা ও বৈদেশিক নীতি নিয়ে চীন দেশটি গত শতকের ষাটের দশকেও বিশ্বের প্রধান পরাশক্তিগুলোর উপহাসের পাত্র ছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্রের জঙ্গি বিমানগুলো প্রতিনিয়ত চীনের আকাশসীমা লঙ্ঘন করত। এর প্রতিক্রিয়ায় চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম পিপলস ডেইলিতে কেবল সাবধানবাণী ছাপা হতো। সেসব সাবধানবাণীর আবার ক্রমিক নম্বর থাকত। আগের প্রদত্ত সাবধানবাণীর নম্বর যদি ১০৯ হয়ে থাকে, তাঁর পরবর্তী নম্বর হতো ১১০। যেমন চীন তাঁর আকাশসীমা লঙ্ঘনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ১১০তম সাবধানবাণী জানিয়ে দিচ্ছে।

বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফারুক চৌধুরী, যিনি যৌবনে চীনের পাকিস্তান দূতাবাসে কাজ করেছেন, তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘জীবনের বালুকাবেলা’য় এ রকম তথ্য পাওয়া যায়। তাঁর ভাষায়, এমন সাবধানবাণী নিয়ে কূটনৈতিক মহলে নানা গল্প প্রচলিত আছে। এক চীনা ভদ্রলোক বাসায় ফিরে তাঁর স্ত্রীকে আরেকজন পুরুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখতে পান। ভদ্রলোকটি তখন গম্ভীর মুখে স্ত্রীর প্রতি সাবধানবাণী উচ্চারণ করলেন, ‘আমি এতদ্দারা তোমাকে আমার ১১০তম ওয়ার্নিং প্রদান করিতেছি।’ তবে চীনকে নিয়ে এমন টিপ্পনির দিন শেষ হয়েছে বহু আগেই। চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান অর্থনীতির দেশ, পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্র।

চীনা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতি গত কয়েক বছরে কমেছে। সরকারি হিসাবেই দেখা যাচ্ছে, ২০১১ সাল পর্যন্ত এক দশকের বেশি সময় শতকরা ১০ ভাগের বেশি প্রবৃদ্ধির হার বজায় ছিল চীনে। ২০১২ থেকে এ হারে নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ২০১৫ সালে এ হার দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৪। এরপর এ হার আরও কমে ৭-এর নিচে নেমে আসে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির অর্থনীতি বেশ ধাক্কা খেয়েছে। প্রবৃদ্ধি থেমে গেছে, তরুণদের বেকারত্ব এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি, আবাসন ব্যবসায় ধস নামছে, বড় বড় কোম্পানি তাদের পণ্য সরবরাহব্যবস্থা ঠিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছে।

খরা, বিদ্যুৎসংকট

কয়েকটি কারণে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাম্প্রতিক সময়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। এর একটি হলো, এ বছর তীব্র খরা মোকাবিলা করেছে দেশটি। বিভিন্ন শহরে তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে। তিব্বতীয় মালভূমিসহ দক্ষিণ চীনের বিশাল অংশে ‘তীব্র’ ও ‘নজিরবিহীন’ খরা পরিস্থিতি তৈরি হয়। খরায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে ইয়াংজি নদী অববাহিকার এলাকাগুলো। ইয়াংজির অববাহিকাটি সাংহাইয়ের উপকূলীয় এলাকা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমের সিচুয়ান প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। ইয়াংজি অববাহিকায় ৩৭ কোটির বেশি মানুষ বাস করে।

তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হওয়ায় একাধিক প্রদেশের শিল্পাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহে সংকট দেখা দেয়। অপর দিকে অনেক শহরে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সংকট মোকাবিলায় হিমশিম খেতে হয় কর্তৃপক্ষকে। এর ফলে অনেক কারখানায় উৎপাদনও বন্ধ হয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং সম্প্রতি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের প্রতি কঠোর হয়েছেন, যদিও দেশটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। এ ছাড়া খরার কারণে জলবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও ঠিকমতো উৎপাদন করতে পারেনি।

এ ছাড়া খরার কারণে কৃষি উৎপাদনে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

শূন্য কোভিড নীতি

দেশটির অর্থনীতি সবচেয়ে বড় সংকটে পড়েছে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের জিরো কোভিড পলিসি বা শূন্য কোভিড নীতির কারণে। এ নীতির মোদ্দা কথা হলো, যে শহরে কোভিড দেখা দেবে, সেই শহর পুরোপুরি লকডাউন করা হবে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হলো, সেটা বিবেচনায় নেওয়া হবে না।

দেশে-বিদেশে তীব্র সমালোচনা সত্ত্বেও চীন সরকার এই নীতি নিয়েই এগোচ্ছে। বাকি বিশ্ব যখন কোভিডের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার নীতি অনুসরণ করছে, শুধু চীন তখন হাঁটছে উল্টো পথে। করোনা অতিমারির দুই বছর পরও চীনকে শক্ত হাতে ভাইরাসটিকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জোরপূর্বক কোয়ারেন্টিন, বাধ্যতামূলক টেস্ট এবং লকডাউন—সবই চলছে। ২০২০ ও ২১ সালে এই নীতি নিয়ে চীন সফল হয়েছিল। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক মৃত্যু ঠেকাতে পেরেছিল। কিন্তু ভাইরাসটির অমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট শূন্য কোভিড নীতিকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

গত তিন সপ্তাহের মধ্যে শেনজেন, যেটি পরিচিত চীনের সিলিকন ভ্যালি হিসেবে; সাংহাই,যেটি চীনের সবচেয়ে বড় ব্যবসাকেন্দ্র—এ দুটিসহ আটটি মেগাসিটিকে পুরোপুরি অথবা আংশিক লকডাউনে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। গত আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে সারা চীনে কমপক্ষে ৭৪টি শহর বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩১ কোটি ৩০ লাখ অধিবাসী।

শূন্য কোভিড নীতির কারণে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে ছোট ব্যবসা যেমন দোকান, বার, রেস্তোরাঁ। অনেক জায়গায় এমন অনেক দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আর খুলছেই না।

প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেয়ে জনগণের ‘জানমালের সুরক্ষা’কে বেশি গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সবচেয়ে বড় ভয় জন–অসন্তোষকে। তা ছাড়া এ মাসেই তিনি তৃতীয় দফায় পার্টির সাধারণ সম্পাদক হবেন কি না, ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসে সে পরীক্ষায় বসতে হবে। সাধারণ সম্পাদক হলে আগামী বছর তিনিই পিপলস কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে অনুমোদন পাবেন।

পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, জিরো কোভিড নীতি থেকে চীন আপাতত সরে আসতে পারবে না। কারণ, দেশটি চাচ্ছে না আবার করোনা রোগীতে হাসপাতালগুলো ভরে উঠুক। সে হিসেবে দেশটির অর্থনীতি সামনে আরও খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, এই নীতি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন; তা না হলে চীনের এ কঠোর নীতি সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

খারাপ অবস্থায় চাকরির বাজার

চীনে চাকরির বাজার কয়েক মাস ধরে খারাপ অবস্থায় আছে। সাম্প্রতিক তথ্য জানাচ্ছে, ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার গত জুলাইয়ে ছিল ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ, যা সাম্প্রতিক কালের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এর অর্থ হচ্ছে, চীনে নগর ও শহরে এখন কর্মহীন তরুণের সংখ্যা ২ কোটি ১০ লাখ। আগামী মাসগুলোয় বেকারত্ব আরও বাড়তে পারে, কারণ করোনার কারণে সামাজিক বিচ্ছিন্নকরণ পদক্ষেপ ক্যাটারিং ও খুচরা শিল্পকে বেজায় ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আর গ্রামীণ এলাকায় বেকারত্বের তথ্য সাধারণত পাওয়া যায় না। তবে সেখানকার পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে বলে ধারণা করা যায়।

আবাসন খাতে সুখবর নেই

এই মুহূর্তে দেশটির আবাসন ব্যবসাও ভালো অবস্থায় নেই। দেশটির জিডিপির ৩০ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। ২০২০ সালের গ্রীষ্মকাল থেকেই নানা ধরনের বিপর্যয় মোকাবিলা করছে আবাসন খাত। সে সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এ খাতের জন্য বরাদ্দ অতিরিক্ত সুবিধা বন্ধ করে দিতে শুরু করে। অভিযোগ রয়েছে, এর জন্য দায়ীও ছিলেন আবাসন খাতের কিছু ব্যবসায়ী। তাঁরা ঋণ পরিশোধ ও প্রকল্প বাস্তবায়নে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছিলেন। যেহেতু আবাসন প্রকল্পগুলোর কাজ থমকে ছিল, তাই ক্রেতারাও মূল্য পরিশোধে আগ্রহ দেখাননি। ফলে আবাসন খাতে বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়। গত আগস্টে আবাসন খাতে বিনিয়োগ ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ কমে।

আবাসন খাতের উন্নতির জন্য সরকার কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন আবাসন প্রতিষ্ঠানকে নগদ সহায়তা এবং বাড়ি কেনার ক্ষেত্রে ছোট আকারের কিস্তি পরিশোধের সুবিধা। চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সুদের হার কমিয়েছে। গত ২২ আগস্ট বাড়ির ক্রেতাদের জন্য এ সুবিধা চালু করা হয়। আগামী বছর আবাসন ব্যবসায় কিছুটা গতি ফিরতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

এক সন্তান নীতি

চীনের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে যাওয়ার জন্য ১৯৭৯ সালে চাপিয়ে দেওয়া কঠোর এক সন্তান নীতিকেও দায়ী করা হচ্ছে। অথচ ওই নীতি করা হয়েছিল দেশটিকে জনসংখ্যার বাড়তি চাপ থেকে মুক্ত রাখতে। তবে ওই নীতির ফলে মেয়েসন্তানের ভ্রূণ নষ্ট করার প্রবণতা তৈরি হয়। মেয়েসন্তানের জন্মহারও কমে যায়। এক সন্তান নীতির ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঠেকানো গেলেও একই সঙ্গে কমে তরুণ ও যুবকদের সংখ্যা, বাড়ে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা। সমাজে শ্রমশক্তির ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। যদিও ২০১৬ সালে সরকার দুই সন্তান নীতি চালু করে এবং গত বছর সরকার তিন সন্তান নীতি চালু করে। তবু জন্মহার বাড়েনি।

প্রবৃদ্ধিতে পিছিয়ে চীন

বিশ্বব্যাংক অতিসম্প্রতি পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার জন্য গ্লোবাল আউটলুক প্রকাশ করে। এতে দেখা যাচ্ছে, এ বছর চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে ২ দশমিক ৮ শতাংশ, আর আগামী বছর ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ ২০২১ সালে এটি ছিল ৮ দশমিক ১ শতাংশ। সংস্থাটির পূর্বাভাসমতে, চীন নয়, এবার পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্রুত এগিয়ে যাওয়া অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে ভিয়েতনাম। অর্থাৎ ১৯৯০ সালের পর প্রথমবারের মতো ওই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পিছিয়ে পড়ছে চীন। সি চিন পিং তৃতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার পর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু চমক দেখা যেতে পারে বলে পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন।