ইলিয়ট হিল
ইলিয়ট হিল

মন্দা সময়ে নাইকির সিইওর দায়িত্ব পেলেন ইলিয়ট হিল

সংকটের সময় করপোরেট সংস্কৃতি কেমন হতে পারে, তার একটি মডেল তৈরি করেছে নাইকি। তাদের মতে, সংকটের সময় ব্যবসায়িক নেতাদের কোম্পানির কর্মীদের কথা শোনা এবং নিজেদের কথা জানানো উচিত। তা না হলে অনেক অপ্রয়োজনীয় সংকট সৃষ্টি হয়।

সম্প্রতি বিশ্ববিখ্যাত ক্রীড়াসামগ্রীর ব্র্যান্ড নাইকির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ইলিয়ট হিল। কোম্পানির এক চ্যালেঞ্জিং সময়ে খুব সাবলীলভাবে দায়িত্ব নিয়েছেন। এ ঘটনা কোম্পানির নেতৃত্বের পালাবদলে বড় নজির হয়ে থাকবে বলে অনেকেই মনে করেন। মূল বিষয় হলো, নতুন নেতৃত্ব বদলের সময় নাইকিতে অভ্যন্তরীণ কোনো গোলযোগ হয়নি। বাজারেও প্রভাব পড়েনি।

নাইকির ব্যবসায়ে এখন কিছুটা মন্দাভাব দেখা যাচ্ছে। নতুন প্রতিযোগীদের কাছে বাজার হারাচ্ছে তারা। এ অবস্থায় নাইকি যাতে আবারও আগের জায়গায় ফিরে আসতে পারে, সে লক্ষ্যেই ইলিয়ট হিলকে কোম্পানির প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

ফোর্বস ম্যাগাজিনের সংবাদে বলা হয়েছে, নেতৃত্বের এমন নির্বিঘ্ন পালাবদল কোম্পানির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একটি কোম্পানির করপোরেট সংস্কৃতি কেমন হবে এবং নতুন নেতৃত্ব দায়িত্ব নেওয়ার পর কতটা সফল হবে, তা কোম্পানির কর্মীদের ওপরই অনেকটা নির্ভর করে। স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট জার্নালের গবেষণার সূত্রে এই খবর দিয়েছে ফোর্বস।

গবেষণায় দেখা গেছে, কোম্পানির কর্মীরা সিইও বা প্রধান নির্বাহীর বিষয়ে সন্তুষ্ট হলে প্রধান নির্বাহীদের চাকরি যাওয়ার হার কমে যায়।

সংকটের সময় করপোরেট সংস্কৃতি কেমন হতে পারে, সে বিষয়েও একটি মডেল তৈরি করেছে নাইকি। বলা হয়েছে, সংকটের সময় ব্যবসায়িক নেতাদের কোম্পানির কর্মীদের কথা শোনা এবং নিজেদের কথা জানানো উচিত। তা না করা হলে অনেক অপ্রয়োজনীয় সংকট সৃষ্টি হয়। অনেক কর্মী চাকরি ছেড়ে চলে যান। গ্যালাপ–এর আরেকটি সমীক্ষায় বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। তারা বলেছে, যত কর্মী চাকরি ছাড়েন, তাঁদের মধ্যে অন্তত ২৫ শতাংশকে ধরে রাখা সম্ভব, যদি তাঁদের সমস্যা ও সংকট আমলে নেওয়া হয়।

নেতৃত্ববিষয়ক পরামর্শক ও ব্যবসায়ী মার্শাল টেরিন ফোর্বসকে বলেন, কর্মক্ষেত্রের মানদণ্ড ও পরিবেশ নির্ধারণ করে দেওয়া নেতৃত্বের কাজ। নেতা হিসেবে যাঁরা শক্তিশালী, তাঁরা নজির স্থাপন করে নেতৃত্ব দেন। যোগ্য নেতৃত্ব যথাযথ কর্মসংস্কৃতি নির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেন; যেখানে সবাই কোম্পানির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে একযোগে কাজ করবে। অযোগ্য মানুষের হাতে নেতৃত্ব গেলে উল্টোটা ঘটতে পারে। তখন বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি ঘটার পাশাপাশি কর্মীদের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না–ও তৈরি হতে পারে। এতে সংগঠনের মূল্য উদ্দেশ্য ক্ষুণ্ন হবে।

টেরিন আরও বলেন, দলনেতার কাজ হলো, সংগঠনে কাজের ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা। চ্যালেঞ্জ বা পরিবর্তনের সময় নিজের নেতৃত্বগুণের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো। পরিবর্তন মানেই খারাপ কিছু নয়; বরং পরিবর্তনকে মানোন্নয়নের সুযোগ হিসেবে দেখুন।

ফোর্বস বলছে, নাইকিতে যেভাবে মৃসণভাবে নেতৃত্বের পরিবর্তন ঘটে গেল, তা ব্যবসায়িক নেতৃত্বের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ নজির হয়ে থাকবে। সংগঠনের অভ্যন্তরীণ নেতৃত্বকে যে গতিশীল হতে হয়, এই ঘটনা তার প্রমাণ। সময়মতো পরিবর্তন ও কর্মসংস্কৃতির উন্নতির জন্য উদ্ভাবনমূলক হওয়া জরুরি।

সবার মতামতের ভিত্তিতে নেতৃত্ব বদল

কোম্পানিতে পরিবর্তন হলে তার প্রভাব অনেকের ওপর পড়ে। কোম্পানির নতুন নীতি ও কৌশল সফল হবে কি না, তা অনেকাংশে এসব মানুষের ওপর নির্ভরশীল। এই অংশীজনদের মধ্যে আছেন ক্রেতা, কর্মী, পর্ষদ সদস্য, সরবরাহকারী ও শেয়ারহোল্ডার। কোম্পানি যত ছোট বা বড় হোক না কেন, তার ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণে এই অংশীজনেরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।

কোম্পানির দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণে যাঁদের কায়েমি স্বার্থ আছে, তাঁদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি করা জরুরি। এর একটি পথ হলো, অংশীজনদের কথা আমলে নিয়ে কোম্পানির নেতৃত্বের মসৃণ পরিবর্তন নিশ্চিত করা। সাবেক সিইও জন ডোনাহোকে সরিয়ে দিতে নাইকি যেভাবে তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত নিল, তা একটি নজির হয়ে থাকবে। সিইওর পদ থেকে সরিয়ে দিলেও ডোনাহোকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে রেখে দেওয়া হয়েছে। যে প্রক্রিয়ায় তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাতে নতুন উত্তরণ পর্ব মসৃণ হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে কোম্পানি।

কোম্পানির বর্তমান হাওয়া বোঝা

পরিবর্তনের প্রক্রিয়া পরিচালনা করা নেতৃত্বের জন্য কঠিন হতে পারে, বিশেষ করে কোম্পানি যখন কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়। কোম্পানি কী অবস্থায় আছে, সেটি বোঝা এবং এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে কৌশল নির্ধারণ করা জরুরি।

আবার দেখা যায়, অনেক কোম্পানির পক্ষে অতীত সফলতার ছায়া অতিক্রম করা কঠিন হয়ে ওঠে। ফলে উদ্ভাবন করা এবং বাজারের বিদ্যমান চাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে ওঠে। অতীতের সফলতা অন্তর্দৃষ্টি হিসেবে ভালো হলেও কেবল তার ভিত্তিতে কোম্পানির কৌশল নির্ধারণ করা কাজের কথা নয়।

নাইকির ক্ষেত্রে বিষয়টি একরকম পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, কোভিড-১৯ মহামারির সময় তৎকালীন সিইও জন ডোনাহোর কৌশল গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা ঠিক; কিন্তু বাজারের বিদ্যমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর নেতৃত্বের ধরন যথাযথ নয় বলে মনে করা হয়। কারণ, ব্যবসার একেক পর্যায়ে নেতৃত্বের একেক ধাঁচের প্রয়োজন হয়।

পুরোনো রীতি-কৌশল ফিরিয়ে আনা

অতীতে যে রীতি ও কৌশল কাজ করছে, তা ফিরিয়ে আনা অনেক সময় কাজে দেয়, যদিও বিষয়টি কখনো কখনো উপেক্ষিত থেকে যায়। বিষয়টি উপেক্ষা করার একটি যুক্তি হলো, অনেকেই মনে করেন যে আগের রীতি-কৌশল ফিরিয়ে আনা সৃজনশীলতার অভাব বা উন্নতির অভাব কিংবা নেতৃত্বের ব্যর্থতা হিসেবে আখ্যায়িত হতে পারে। কিন্তু এই ধারণা সত্য নয়। বাস্তবতা হলো, সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে পুরোনো কৌশলের পুনর্ব্যবহার কাজে দেয়।

নাইকির নতুন সিইও ইলিয়ট হিল একসময় নাইকিতে কাজ করতেন। ১৯৮৮ সালে শিক্ষানবিশ বিক্রয়কর্মী (সেলস ইন্টার্নশিপ) হিসেবে নাইকিতে ইলিয়টের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এরপর বিভিন্ন পদে কাজ করে ২০২০ সালে তিনি অবসরে যান। ৩৬ বছর পরে ২০২৪ সালে তাঁকেই কোম্পানির সিইও করা হয়েছে। তাঁকে আবার ফিরিয়ে আনার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, নাইকির প্রবৃদ্ধিতে তাঁর অবদান ছিল। অর্থাৎ কোম্পানির সফল ইতিহাস কখনো কখনো ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টির উৎস হতে পারে।

ব্যবসায়িক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে প্রতিটি সিদ্ধান্তই গুরুত্বপূর্ণ। ছোট বা বড়, যে ধরনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হোক না কেন, এসব প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব প্রায়ই চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মুখে পড়েন। সে জন্য সব বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। নাইকির এই পরিবর্তন তথা ইলিয়ট হিলের পদায়নের ঘটনা বড় নজির হয়ে থাকবে।