রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় কাজ হচ্ছে না, বলেছেন দুবাইয়ের ব্যবসায়ী নেতা

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পশ্চিমারা মস্কোর ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, পশ্চিমা পৃথিবীর বাইরে তার প্রভাব নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি রোখার চেষ্টায় ফল হয় না, বরং তা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়। দুবাইয়ের এক বাণিজ্য কেন্দ্রের প্রধান এ কথা বলেছেন।

দুবাই মাল্টি কমোডিটিস সেন্টারের (ডিএমসিসি) চেয়ারম্যান হামাদ বুয়ামিম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা অর্থনীতির গতি কমিয়ে দিতে পারে; তবে কখনোই অর্থনীতিকে রুদ্ধ করতে পারে না। ...বাণিজ্যের প্রবাহ ঠিক-ই থাকে, শুধু তার গতি বদলে যায়।’

রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা আরোপে যেসব দেশ লাভবান হয়েছে, তাদের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত অন্যতম। এমনিতেই রাশিয়ার ধনকুবেরদের প্রিয় জায়গায় দুবাই। তার ওপর সুইজারল্যান্ড মার্কিনীদের নেতৃত্বে নিষেধাজ্ঞায় আরোপের উদ্যোগে যোগ দিলে তেল ব্যবসায়ীরা জেনেভা থেকে আরব আমিরাতে চলে আসেন। ডিএমসিসির চেয়ারম্যানের এ কথা বলার এটাই মূল কারণ। এই ব্যবসায়িক কেন্দ্রের মূল ব্যবসা হলো তেল; প্রায় তিন হাজার তেল কোম্পানি ডিএমসিসিতে তালিকাভুক্ত।

তবে পশ্চিমারা আরব আমিরাতকেও ছেড়ে কথা বলছে না। যেসব কোম্পানি রুশ কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা করছে, সেই কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাপ দিয়ে যাচ্ছে তারা।

হামাদ বুয়ামিম বলেন, অর্থনীতি বিশ্বের একটি অংশের হাতে সীমাবদ্ধ নয়, সে জন্য নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা কমে গেছে। রাশিয়া-ইউক্রেনের বিষয়টি পশ্চিমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মনে হবে, এসব নিষেধাজ্ঞায় কাজ হচ্ছে। কিন্তু তার বাইরে এসব নিষেধাজ্ঞার মূল্য নেই।

ডিএমসিসি চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যে বড় কিছু হবে, আমরা তা মনে করি না। এসব কারণে যা হচ্ছে তা হলো, বাণিজ্য আরও বেশি জটিল হচ্ছে আর সারা বিশ্বেই তার প্রভাব পড়ছে।’

যেসব আন্তর্জাতিক ব্যাংক বাণিজ্যে অর্থায়ন করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের লক্ষ্যবস্তু করেছে। যুক্তরাজ্য সুনির্দিষ্টভাবে প্যারামাউন্ট এনার্জি অ্যান্ড কমোডিটিস নামের দুবাইভিত্তিক তেল কোম্পানির বিরুদ্ধে লেগেছে। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, জি–৭ ভুক্ত দেশগুলো যখন রাশিয়ার তেলের দাম বেঁধে দিল, ঠিক সেই সময় এই কোম্পানি গঠিত হয়।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ঝুঁকিপূর্ণ বা ধূসর দেশের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে জোটের সিংহভাগ সদস্য ভোট দিয়েছে। অর্থাৎ আরব আমিরাত ইইউয়ের চোখে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। ইইউর অভিযোগ, আরব আমিরাত রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা আমলে নিতে শিথিলতা দেখিয়েছে; বিষয়টি এখন ইউরোপীয় কমিশনের হাতে।

তবে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা ও সীমাবদ্ধতা আরোপের কারণে দেশটির পক্ষে উন্নত মানের অস্ত্র তৈরি করা কঠিন হয়ে গেছে, যেটা তারা যুদ্ধের শুরুতে করতে পেরেছে।

বাণিজ্যিকভাবেও রাশিয়া কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফিনল্যান্ডের জ্বালানিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিআরইএ বলছে, রাশিয়ার তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটি কম দামে বা ছাড় দিয়ে তেল বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে ২০২৩ সালে রাশিয়ার ক্ষতি হয়েছে ৩৪ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৪০০ কোটি ইউরো।

সম্প্রতি গ্যাজপ্রম ৭০০ কোটি ডলার ক্ষতির কথা বলেছে। রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ অভিযান শুরু করার পর এই ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া দেশে দেশে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমুখী ব্যবস্থার কারণে রাশিয়ার আমদানি ব্যয় বেড়েছে।

হামাদ বুয়ামিম বলেন, শুধু রাশিয়া থেকে নয়, অন্যান্য দেশ থেকেও কোম্পানিগুলো দুবাইয়ে আসছে। তাদের প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে সুইজারল্যান্ডের কোম্পানিগুলোর বদৌলতে।

এ ছাড়া যেসব আন্তর্জাতিক কোম্পানি রাশিয়া ছাড়তে বাধ্য হয়েছে তাদের এমন এক জায়গায় ব্যবসা স্থানান্তর করা প্রয়োজন ছিল, যেখানে রুশ কর্মীরা স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারেন। দুবাই তেমন এক জায়গা বলে মনে করেন হামাদ বুয়ামিম।

দুবাই এখন বৈশ্বিক বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র। অভিবাসন আইনে ছাড়ের কারণে সারা বিশ্বের ধনকুবেররা সেখানে পাড়ি জমাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত দেশটি ভূরাজনীতিতে এক ধরনের নিরপেক্ষ ভূমিকা বজায় রেখেছে, অর্থাৎ তারা না মার্কিনপন্থী, না চীন বিরোধী। কিন্তু বুয়ামিম বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে পক্ষ নিতে চাপ দিচ্ছে তাতে এই নিরপেক্ষতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে।

হামাদ বুয়ামিম বলেন, শীর্ষ রাজনীতিকদের মধ্যে এখন সবচেয়ে বড় অ্যাজেন্ডা হচ্ছে সুরক্ষাবাদ। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো রাজনীতি প্রভাবিত, যেগুলো ঠিক বাণিজ্যিকভাবে যথাযথ নয়। বিষয়টিকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করেন তিনি।

ডিএমসিসি চেয়ারম্যান বলেন, ভূরাজনীতিতে চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব এখন আর কেবল তাদের মধ্যে সীমিত নেই, সারা বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।