রাশিয়ার প্রতিবেশী বেশ কয়েকটি দেশ জার্মানি থেকে হঠাৎ করে আমদানি অনেক বাড়িয়েছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসের পরিসংখ্যানে এমনটা দেখা গেছে। ফলে উদ্বেগ বাড়ছে যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে মস্কোর ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে এসব দেশ থেকে জার্মান পণ্য আবার রাশিয়ায় পুনরায় রপ্তানি হচ্ছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানাচ্ছে, জানুয়ারি-মার্চ সময়ে জার্মানি থেকে রাশিয়ায় সরাসরি রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৭ শতাংশেরও বেশি কমেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ রাশিয়ার ওপর যেসব কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তার কারণেই সে দেশে জার্মান রপ্তানি কমে যায়।
কিন্তু একই সময়ে রাশিয়ার মধ্য এশীয় প্রতিবেশী দেশ কিরগিজস্তানে জার্মানির রপ্তানি ৯৪৯ শতাংশ বেড়ে ১৭ কোটি ইউরো বা ১৮ কোটি ৭১ লাখ ডলার হয়েছে বলে জার্মান পরিসংখ্যান দপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে রয়টার্স দেখতে পেয়েছে।
অন্য কয়েকটি দেশে মোট মূল্যের হিসাবে জার্মানির রপ্তানির পরিমাণ কম, তবে জানুয়ারি-মার্চ সময়ে প্রবৃদ্ধির হার অনেক বেশি। যেমন জর্জিয়ায় রপ্তানি বেড়েছে ৯২ শতাংশ, কাজাখস্তানে বেড়েছে ১৩৬ শতাংশ, আর্মেনিয়ায় ১৭২ শতাংশ এবং তাজিকিস্তানে ১৫৪ শতাংশ।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের পর এসব দেশে জার্মানির বাণিজ্য বেড়েছিল। তবে চলতি বছরে বিপুল রপ্তানির এই পরিসংখ্যান উদ্বেগ জোরদার করছে যে প্রতিবেশী দেশগুলোর ব্যবসায়ীরা পণ্য বিক্রি করার পর নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা এসব পণ্য শেষ পর্যন্ত রাশিয়ায় গিয়ে পৌঁছাচ্ছে।
অস্ট্রিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চের প্রেসিডেন্ট এবং বাণিজ্যবিশেষজ্ঞ গ্যাব্রিয়েল ফেলবারমায়ের বলেন, ‘এ রকম প্রবৃদ্ধি আর কীভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে?’
ধনী দেশগুলোর জোট জি-৭ নেতারা চলতি সপ্তাহে জাপানে তাদের শীর্ষ সম্মেলনে রাশিয়ার ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করার বিষয়ে আলোচনা করবেন। তৃতীয় দেশের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর যেসব ঘটনা ঘটছে, সেসব বিষয়েও জি-৭ নেতাদের বৈঠকে আলোচনা হবে বলে কথা রয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো আরও কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার বিষয়ে আলোচনা করছে। এটি হবে তাদের ১১তম বারের মতো নিষেধাজ্ঞা আরোপ। রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, সেগুলো যেসব ব্যক্তি বা দেশ পাশ কাটাচ্ছে, এই দফায় তাদের লক্ষ্যবস্তু করা হবে।
জার্মানির অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়ান লিন্ডনার মঙ্গলবার ব্রাসেলসে বলেছেন, ‘রাশিয়ার বিরুদ্ধে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটিয়ে যাওয়া অগ্রহণযোগ্য।’
তবে পশ্চিমা যেসব দেশ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাদের সেই পদক্ষেপের সঙ্গে যারা নেই, তাদের ক্ষেত্রে পণ্য পুনঃ রপ্তানি বন্ধ করা কাস্টমস এবং বাণিজ্য চুক্তির কারণে একটা জটিল ব্যাপার। অস্ট্রিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চের গ্যাব্রিয়েল ফেলবারমায়ের বলেন, ‘আর্মেনিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান এবং কিরগিজস্তান রাশিয়ার সঙ্গে একটি কাস্টমস ইউনিয়নের সদস্য।’
তিনি বলেন, ‘এর মানে হলো, একটি তৃতীয় দেশের সাপেক্ষে তাদের একটি যৌথ কাস্টমস ব্যবস্থা রয়েছে এবং ইউরোপ থেকে যে পণ্য কিরগিজস্তানে যায়, সেই পণ্য আবার কোনো রকম কাস্টমস নিয়ন্ত্রণ এবং শুল্ক পরিশোধ ছাড়াই রাশিয়ার কাছে বিক্রি করা যেতে পারে।’
কিরগিজস্তানে বছরের প্রথম তিন মাসে বিশেষ করে মোটরগাড়ি এবং গাড়ির যন্ত্রাংশের রপ্তানি বেশি বেড়েছে। গত বছরের একই সময়ে ৮ কোটি ৪০ লাখ ইউরো মূল্যমানের পণ্য সেখানে রপ্তানি হয়েছিল। এ বছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে চার হাজার শতাংশ। ধাতুপণ্য, রাসায়নিক দ্রব্য এবং পোশাক—এসব পণ্যের প্রতিটির রপ্তানি এক হাজার শতাংশের বেশি বেড়েছে।
গত বছরে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর কিরগিজস্তানে জার্মানির রপ্তানি ছয় গুণ বেড়েছিল। তার ওপর এসেছে চলতি বছরের প্রবৃদ্ধি। রাশিয়ার কাছাকাছি অবস্থিত এমন দেশে ‘জার্মানিতে তৈরি’ এমন পণ্যের রপ্তানিও গত বছর বেড়েছিল।
তুরস্ক হলো আরেকটি দেশ, যেখান থেকে রাশিয়ায় জার্মান পণ্য যেতে পারে বলে মনে করা হয়। সে দেশে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে জার্মানির পণ্য রপ্তানি ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। আর্থিক মূল্যে এর পরিমাণ ছিল ৮০০ কোটি ইউরোর সামান্য নিচে। এ সময় জার্মানির পণ্য রপ্তানির সার্বিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ।
তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাস্টমস ব্যবস্থার অংশ।
অস্ট্রিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চের গ্যাব্রিয়েল ফেলবারমায়ের বলেন, ‘এর মানে হলো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে শিল্পপণ্য বিনা শুল্কে তুরস্কে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু তুরস্ক যেহেতু ইইউর নিষেধাজ্ঞা কর্মসূচিতে যোগ দেয়নি, তাই সেখান থেকে ইইউর পণ্য রাশিয়ায় পুনরায় রপ্তানি হতে পারে।’
একই ঘটনা ঘটতে পারে তুরস্ক থেকে জার্মানিতে আমদানির ক্ষেত্রে। গ্যাব্রিয়েল ফেলবারমায়ের বলেন, এসব আমদানি পণ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রাশিয়ার তৈরি কাঁচামাল থাকতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু করারও থাকবে না।
তবে জি-৭ থেকে চাপ আসার পর তুরস্ক এ বছরের আরও আগের দিকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা পশ্চিমা পণ্য রাশিয়ায় পাঠানো বন্ধ করতে রাজি হয়েছে। মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা চলতি মাসে বলেছেন যে তুরস্কের বাণিজ্যসংক্রান্ত তথ্যে এ বিষয়টি লক্ষ করা গেছে।
রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা যাতে মেনে চলা হয়, তা নিশ্চিত করতে ওয়াশিংটন সম্প্রতি বিভিন্ন দেশ ও বেসরকারি কোম্পানির ওপর কূটনৈতিক চাপ বাড়িয়েছে।
একজন জ্যেষ্ঠ ইইউ কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে তাদের রপ্তানি করা পণ্য শেষ পর্যন্ত কারা ব্যবহার করছে, সে সম্পর্কে তারা জানে। যদি তারা সেটা না করতে পারে, তাহলে নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটানোর দায়ে তাদের অভিযুক্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনি যদি হঠাৎ করে দেখেন, যেসব পণ্য আপনার কোম্পানি একসময় রাশিয়ায় রপ্তানি করত, তা তৃতীয় আরেকটি দেশে বেশি পরিমাণে রপ্তানি হচ্ছে, আমার মনে হয় তখন আপনার নিজেকেই জিজ্ঞাসা করা উচিত যে আপনি নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটানোর ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখছেন না তো?’