চলতি সপ্তাহান্তেই ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংক বিক্রি করে দিতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। প্রায় ছয়টি ব্যাংক এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি কেনার জন্য দর দেবে বলে জানা যাচ্ছে। এর আগে আরও দুটি মার্কিন ব্যাংককে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসতে হয়েছিল নিয়ন্ত্রকদের।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সংবাদে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন (এফডিআইসি) ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংক নিলামে তুলেছে। যেসব বড় ব্যাংক এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে, সেগুলো হলো—সিটিজেন ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ ইনকরপোরেশন, পিএনজি ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস গ্রুপ, জেপি মরগান চেজ অ্যান্ড কোম্পানি। এ ছাড়া ইউএস ব্যাংকিং করপোরেশনকেও এফডিআইসি দরপত্র জমা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
এই নিলামপ্রক্রিয়ায় এফডিআইসিকে পরামর্শ দিচ্ছে গুগেনহেম সিকিউরিটিস।
তিনটি সূত্রে থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রয়টার্স জানিয়েছে, এফডিআইসি গত সপ্তাহে এই নিলামপ্রক্রিয়া শুরু করে। দরদাতাদের বলা হয়েছিল, গত শুক্রবারের মধ্যে তারা যেন দরপত্র জমা দেয়, তবে সেই দরের বাধ্যবাধকতা থাকবে না। দরদাতারা গত এক সপ্তাহে ফার্স্ট রিপাবলিকের সবকিছু খতিয়ে দেখেছে।
এশিয়ার বাজার খোলার আগে অর্থাৎ স্থানীয় সময় সোমবার সকালের আগে এই বিক্রয় চুক্তি সেরে ফেলতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো। তারা সম্ভবত বলতে চায় যে ফার্স্ট রিপাবলিক এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার হাতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় রোববার দুপুরের মধ্যে দরপত্র জমা দিতে হবে।
আগ্রহী ব্যাংকগুলো এখন খতিয়ে দেখছে, তারা ঠিক কী দর দেবে। একটি সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, দরদাতারা সম্ভবত ফার্স্ট রিপাবলিকের সব আমানত, সম্পদের বড় অংশ ও কিছু দায়ের জন্য দর দেবে।
এদিকে নিলামপ্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে ইউএস ব্যাংকিং করপোরেশন রয়টার্সকে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু জানায়নি। এ ছাড়া ফার্স্ট রিপাবলিক, এফডিআইসি, গুগেনহেম ও অন্যান্য ব্যাংক মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
বছরের প্রথম প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ সময় ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংকের আমানত ১০ হাজার কোটি ডলারের বেশি কমেছে। তখন থেকেই কার্যত বিষয়টি ছিল সময়ের অপেক্ষা, এফডিআইসি কবে এই ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেবে।
সপ্তাহের শেষ দিন শুক্রবার লেনদেনের বর্ধিত সময়ে ফার্স্ট রিপাবলিকের শেয়ারের দাম ৪৩ শতাংশ কমেছে। তাতে গত এক সপ্তাহেই ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংকের শেয়ারদর কমেছে ৭৫ শতাংশ, যার অর্ধেকেরও বেশি কমেছে শুক্রবার। ফলে ফার্স্ট রিপাবলিকের শেয়ারদর রেকর্ড পরিমাণে কমে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৯৯ ডলার।
২০২১ সালের নভেম্বরে ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংকের বাজার মূলধন ছিল ৪০ বিলিয়ন বা ৪ হাজার কোটি ডলার। এই টালমাটালের মধ্যে একসময় তা প্রায় ৫৬ কোটি ডলারে নেমে আসে।
ফার্স্ট রিপাবলিকের দুর্যোগের মধ্যে শুক্রবার আরও কয়েকটি আঞ্চলিক ব্যাংকের শেয়ারদরও কমেছে। প্যাকওয়েস্ট ব্যাংক করপোরেশনের শেয়ারদর কমেছে ২ শতাংশ, ওয়েস্টার্ন অ্যালায়েন্সের শেয়ারদর কমেছে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ।
গত মার্চে তিন দিনের মধ্যে দুটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে—সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক ও সিগনেচার ব্যাংক। নিউইয়র্ক টাইমসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যম মানের ব্যাংকগুলো সংকটের মুখে পড়েছে। এই দুটি ব্যাংক যে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল, তা মূলত এ কারণেই।
এই মধ্যম মানের ব্যাংকগুলোর গ্রাহক ভিত্তি জেপি মরগানের মতো মহিরুহ ব্যাংকগুলোর মতো অতটা বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়। যেমন এসভিবি ব্যাংকের গ্রাহক ছিল মূলত স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো। সিগনেচার ব্যাংক ঋণ দিত মূলত আবাসন খাতে। সেই সঙ্গে তারা সম্প্রতি ক্রিপ্টোকারেন্সির গ্রাহকদের টানতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিল।
এসভিবি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, সিগনেচার ব্যাংক অনেকটা তার জেরেই বন্ধ হয়েছে। দেশটির নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভাষ্য, এই দুটি ব্যাংক বন্ধ করা না হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ত।
গত সপ্তাহে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের গ্রাহকদের অর্থ তুলে নেওয়ার হিড়িক শুরু হলে সিগনেচার ব্যাংকের গ্রাহকেরাও জানতে চান, তাঁদের আমানত সুরক্ষিত কি না। অনেকের মনেই আতঙ্ক সৃষ্টি হয় এ কারণে যে তাঁদের আমানতের পরিমাণ আড়াই লাখ ডলারের বেশি। দেশটির ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন বা এফডিআইসি আড়াই লাখ ডলার পর্যন্ত আমানতের সুরক্ষা দেয়, তার বেশি নয়।
এসভিবি নগদ জোগানের ভারসাম্যের তোয়াক্কা না করে বন্ডে দীর্ঘ মেয়াদে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছিল। আমেরিকার বাজারে তখন নীতি সুদের হার প্রায় শূন্য। তখন কোভিডও আসেনি। লকডাউন নেই, লাগাম ছাড়া মূল্যস্ফীতিও নেই। সমস্যার শুরু হলো লকডাউন–উত্তর ক্রমেই বেড়ে চলা মূল্যস্ফীতির কারণেই।
ঋণপত্র বা বন্ডের দাম সুদ হারের বিপরীত—অর্থাৎ সুদহার বাড়লে বন্ডের দাম কমে, আর কমলে বন্ডের দাম বাড়ে। এর কারণ হলো, বন্ড যখন কেউ কেনে, তখন তাতে নিদিষ্ট হারে সুদের প্রতিশ্রুতি থাকে। এরপর বাজারে সুদের হার বাড়লে কেউ যদি আগের বন্ড অন্যের কাছ থেকে একই দামে কেনে, তা হলে আগের হারে সুদ পাবে, যা বাজারে চলতি সুদ হারের চেয়ে কম।
বাজারে চলতি সুদ হারের সঙ্গে পা মিলিয়ে মুনাফা পেতে গেলে ক্রেতাকে ওই বন্ড আগের চেয়ে আনুপাতিক হারে এত কমে কিনতে হবে, যাতে তার সুদহার বাজারে চলমান সুদের সমান হয়। সুদহার কমলে এর ঠিক উল্টোটা ঘটবে।
সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক ঠিক এ কারণেই বিপদে পড়ে; অর্থাৎ বাজারে সুদহার বাড়তে থাকায় তাদের কেনা বন্ডের দাম কমতে থাকে। ফলে স্থিতিপত্রে তাদের মুনাফা কমতে থাকে। গত ৮ মার্চ ব্যাংকটি বন্ডে বিনিয়োগ বাবদ ১৮০ কোটি ডলার ক্ষতির কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হলো। এরপর আমানতকারীরা রাতারাতি তাদের জমা টাকা এই ব্যাংক থেকে সরিয়ে নেওয়া শুরু করে।
এর জেরে বন্ধ হয়ে যায় সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক। তার তিন দিনের মধ্যে বন্ধ হয় সিগনেচার ব্যাংক, আর এখন অনেকটা একই পথে আছে ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংক।