বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে ডলারের পরিমাণ কমছে, বাড়ছে সোনার পরিমাণ। এত দিন উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে এই প্রবণতা থাকলেও এখন উন্নত দেশগুলোও সেই পথে হাঁটছে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের (ডব্লিউজিসি) বার্ষিক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
২০২৫ সালে বিশ্বের ধনী দেশগুলোর মধ্যে ১৩ শতাংশ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সোনার মজুত বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে বলে জরিপে জানা গেছে। অথচ এক বছর আগেও মাত্র ৮ শতাংশ ধনী দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই পরিকল্পনা ছিল। এমনকি গোল্ড কাউন্সিলের জরিপ শুরু হওয়ার পর থেকে তখন পর্যন্ত সেটিই ছিল সর্বোচ্চ।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জরিপে অংশ নেওয়া বিশ্বের ধনী দেশগুলোর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধারণা, আগামী পাঁচ বছরে তাদের মজুতে সোনার পরিমাণ অনেকটাই বাড়বে। গত বছরে এমন কথা বলেছিল মাত্র ৩৮ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে এখন পর্যন্ত সোনা কেনায় এগিয়ে আছে উদীয়মান অর্থনীতির কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের সময় থেকে তারাই সোনার মূল ক্রেতা।
চলতি বছর সোনার দাম যে অনেকটা বেড়েছে, তার পেছনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সোনা মজুত প্রবণতা বৃদ্ধির যোগ আছে বলেই ধারণা করেন বিশ্লেষকেরা। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিপুল পরিমাণ অর্থ জব্দ করায় দেশগুলোর মধ্যে এই প্রবণতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ডলারের বিনিময় হার বাড়িয়ে আমদানিকারক দেশগুলোকে বিপদে ফেলেছে, সেই অভিজ্ঞতা থেকেও অনেক দেশ সোনা মজুতের দিকে ঝুঁকেছে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের রিজার্ভ বহুমুখী করছে।
বৈশ্বিক রিজার্ভে সামষ্টিকভাবে মার্কিন ডলারের আধিপত্য যে কমবে, বিশ্বের ধনী দেশগুলোর মধ্যে অর্ধেকের বেশি বা ৫৬ শতাংশ দেশ তা অনুমান করছে। আগের বছর এমন ধারণার কথা জানিয়েছিল ৪৬ শতাংশ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্যদিকে উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর ৬৪ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ধারণা পোষণ করে।
ডব্লিউজিসির কেন্দ্রীয় ব্যাংকবিষয়ক প্রধান শাওকাই ফান বলেন, এ বছর উন্নত দেশগুলোর মধ্যে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। উন্নত অর্থনীতিগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বলছে, বৈশ্বিক রিজার্ভে সোনার হিস্যা বাড়বে, কমবে ডলারের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ব্যবস্থাপকেরা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের এই সমীক্ষায় মতামত দেন। এই কর্মকর্তারা সচরাচর রিজার্ভ নিয়ে এতটা জনসমক্ষে কথা বলেন না।
ডব্লিউজিসি পাঁচ বছর আগে প্রথম এই জরিপ শুরু করে, এরপর প্রতিবছরই তারা সেটা করেছে। এবারের জরিপে দেখা গেছে, রেকর্ডসংখ্যক কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী ১২ মাসে সোনার মজুত বাড়াতে চায়। জরিপে অংশ নেওয়া ২৯ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ ব্যবস্থাপক এমন পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন এবার। তবে উদীয়মান অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই ভাবনা ৪০ শতাংশের।
ডব্লিউজিসির তথ্যানুসারে, ২০২২ ও ২০২৩ সালে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর রিজার্ভে এক হাজার টন করে সোনা যুক্ত হয়েছে। রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মস্কোর সঙ্গে বাণিজ্যে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ডলারব্যবস্থা ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তার জেরে ভারত, চীনসহ যেসব দেশের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্যিক লেনদেন রয়েছে, তারা সোনা কেনায় উৎসাহিত হচ্ছে। সোনার বাজারমূল্য কোনো দেশের সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেঁধে দেয় না।
সোনার ব্যবহার কেবল অলংকার তৈরির মধ্যে সীমিত নয়, বরং বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে সোনা আরও গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকের সুদহার বাড়লে বা শেয়ারবাজার শক্তিশালী হলে বিনিয়োগকারীরা তখন এসবের মধ্যে বিকল্প বিনিয়োগের মাধ্যম খুঁজে পান। তখন সোনার চাহিদা কমে। সে কারণে ২০২২ ও ২০২৩ সালে বিনিয়োগকারীরা ডলারভিত্তিক বন্ডে বিনিয়োগ করেছেন। এখন ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার হ্রাস করলে বন্ডের সুদহারও কমে যাবে, সে জন্য বিনিয়োগকারীরা আগেভাগে সোনায় বিনিয়োগ করছেন। সেই সঙ্গে আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সোনা মজুত বৃদ্ধির প্রবণতা।
২০২৩ সালে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে সোনার হার ছিল ৫৫ শতাংশ, ২০০০ সালে যা ছিল ৭০ শতাংশ। এখন বিশ্ববাজারে সোনার দাম আউন্সপ্রতি ২ হাজার ৩৩৭ ডলার; গত ছয় মাসে সোনার দাম বেড়েছে ১৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ।