আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা নেওয়ার তিন বছর হলো। এ সময়ে নিরাপত্তা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও দেশটির অর্থনীতি একরকম স্থবির। পাশাপাশি দেশটির মানবিক সংকট দিন দিন বাড়ছে।
জাতিসংঘের হিসাবে দেশটির প্রায় ৪০ লাখ মানুষ শুধু রুটি ও চা খেয়ে বেঁচে আছে। বেকারত্ব প্রকট। আগামী তিন বছরে দেশটির কোনো প্রবৃদ্ধি হবে না বলে আশঙ্কা বিশ্বব্যাংকের।
তবে তালেবানের যে একেবারে কোনো সফলতা নেই, তা নয়। ২০২১ সালে তারা ক্ষমতা নেওয়ার দেশটিতে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, যদিও কোনো দেশ এখন পর্যন্ত তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। দেশটির মুদ্রার বিনিময় মূল্য বেড়েছে, দুর্নীতি কমেছে আর কর সংগ্রহ বেড়েছে। খবর এএফপির।
দেশটির বাণিজ্য ও শিল্পবিষয়ক উপমন্ত্রী আহমাদ জাহিদ বলেন, এ অঞ্চলে ‘অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, ট্রানজিট ও বিনিয়োগ’ সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছে সরকার।
আফগানিস্তানের প্রচুর খনিজ সম্পদ আছে; সেই সঙ্গে আছে কৃষি খাতে উন্নয়নের সম্ভাবনা। তালেবান সেগুলো কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু দুর্বল অবকাঠামো, দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞের ঘাটতি ও সম্পদের অভাবে তা পারছে না। যদিও আফগানরা নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতির বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছে। দেশের যা পরিস্থিতি, অনেকে কেবল চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছেন।
মার্কিন সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ২০০১ সালে আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের পতন হয়েছিল। এর ঠিক ২০ বছর পর ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান ছাড়ে। দেশটি তখন তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এ অবস্থায় দেশের মানুষ ও অর্থনীতি কেমন আছে, তা জানতে বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে কথা বলেছে এএফপি।
আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলীয় হেরাত প্রদেশে ৫৪ বছর বয়সী আজিজুল্লাহ রেহমাতির জাফরানের ব্যবসা। তাঁর ব্যবসা দিন দিন বড় হচ্ছে। আশা করছেন, তাঁর রেড গোল্ড স্যাফরন কোম্পানি এ বছর দ্বিগুণ উৎপাদন করবে।
২০২১ সাল পর্যন্ত রেহমাতি এই দামি মসলা সশস্ত্র বাহিনীর নিরাপত্তা প্রহরায় কারখানা থেকে বিমানবন্দরে পণ্য আনা-নেওয়া করতেন। কিন্তু এখন আর তার প্রয়োজন হয় না। তিনি ২৭টি দেশে জাফরান রপ্তানি করেন। বলেন, এখন কোনো সমস্যা নেই।
কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। তালেবান সরকার দেশটিতে নারীদের কাজ করার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। এতে তাঁর কোম্পানিতে নারী কর্মীর সংখ্যা কমেছে। রেহমাতির প্রতিষ্ঠানসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান অবশ্য এখনো নারীদের কাজে নিয়োগ দিচ্ছে।
দেশটির ব্যাংকিং ব্যবস্থাও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। বিষয়টি আফগানিস্তানের মতো রেহমাতির জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ।
গত সরকারের উপবাণিজ্যমন্ত্রী সুলাইমান বিন শাহ বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলগুলো পুনরায় খুলেছে; বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এই খাত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় মুখ থুবড়ে পড়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব সম্পদ জব্দ করা হয়েছিল।
রেহমাতি নিজের ব্যাংক হিসাব থেকে বাইরে অর্থ পাঠাতে পারছিলেন না আবার অর্থ আসছিলও না। তালেবান ক্ষমতা দখলের পর অনেক দেশ আফগানিস্তানে দূতাবাস বন্ধ করে দেয়। ফলে বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভিসা পাওয়া বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ ছাড়া হেনরি সূচক অনুযায়ী, আফগানিস্তানের পাসপোর্ট বিশ্বে সবচেয়ে দুর্বল। এ অবস্থায় বিশ্ববাজারে তাঁরা পিছিয়ে পড়বেন বলে হতাশা প্রকাশ করেন রেহমাতি।
কর্মহীন হয়ে পড়েছেন শিল্পীরা
ওয়াহিদ নেকজাই লোগারি আফগানিস্তানের জাতীয় অর্কেস্ট্রা দলের যন্ত্রশিল্পী ছিলেন। তিনি কনসার্টে সারিন্দা ও হারমোনিয়াম বাজাতেন। ৪৬ বছর বয়সী ওয়াহিদের বাড়ি কাবুলের শহরতলিতে। তিনি বলেন, ‘আমি পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল মানুষ; আমাদের সুন্দর জীবন ছিল।’ কিন্তু তালেবান সরকার অনৈসলামিক দাবি করে প্রকাশ্যে সব ধরনের গানবাজনা নিষিদ্ধ করে। ফলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত শত শত মানুষ বেকার হয়ে পড়েন।
ওয়াহিদ নেকজাই আরও বলেন, তিনি এখন বেকার। সাত সদস্যের পরিবার চালাতে এখন মাঝেমধ্যে ক্যাব চালান; মাসে আয় হয় মাত্র ৫ হাজার আফগানি। অথচ আগে কনসার্ট করে মাসে এর চেয়ে ৫ গুণ বেশি আয় করতেন। কেউ তাঁদের বলেনি, ‘তুমি আর কখনো বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারবে না, কিন্তু আমরা তোমাকে পরিবার চালানোর অন্য উপায় খুঁজে দেব।’
বিদ্রোহী থেকে আমলা
আবদুল ওয়ালি শাহিন যখন তালেবান যোদ্ধা ছিলেন, তখন তিনি ‘শহীদের মৃত্যু’ চেয়েছিলেন। কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় আসার পর তিনি গজনি প্রদেশের তথ্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কাজ পান। আগে তাঁর হাতে থাকত রকেট; এখন তাঁর হাতের আঙুল কম্পিউটারের কি–বোর্ডে ঘোরাফেরা করে। ৩১ বছর বয়সী এই ব্যক্তি বলেন, ‘এখন যত চাপ নিয়ে কাজ করতে হয়, আগে তা কখনোই ছিল না। আগে আমরা জিহাদের জন্য সব করতাম; কিন্তু এখন জনগণের প্রতি অনেক দায়িত্ব; এই কাজ বড় কঠিন।’
শাহিনের মাসিক বেতন ১০ হাজার আফগানি। পাঁচ সদস্যের পরিবারের খরচ চালানোর জন্য এটা পর্যাপ্ত এবং দেশ যেদিকে যাচ্ছে, তাতে তিনি খুশি। তিনি বলেন, ‘এই তিন বছরের জন্য আমি সরকারকে ১০-এ ১০ দেব। সব ভালো চলছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা আশাবাদী।’
আত্মগোপনে রূপচর্চাকারীরা
গত বছর বিউটি পারলার বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ এলে সাইদার হৃদয় ভেঙে যায়, যদিও চার মাসে আগে কাবুলের গোপন এক স্থানে আবারও পারলার খুলেছেন তিনি। ২১ বছর বয়সী এই তরুণী পারলারের ব্যবস্থাপক। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখলাম, এই জায়গাটি ভাড়ার দেওয়া হবে। এরপর মালিকের সঙ্গে চুক্তি হলো এ রকম—গ্রাহকেরা গোপনে এখানে আসা–যাওয়া করবে এবং কিছু কর্মী সেখানে রাতে থাকবে। এর উদ্দেশ্য হলো প্রতিবেশীদের এটা বোঝানো যে এখানে পরিবার থাকে।’
আগে দিনে ৩০ থেকে ৪০ জন গ্রাহক আসতেন সাইদার দোকানে; এখন সেই সংখ্যা ৬ থেকে ৭-এ নেমে এসেছে। তারপরও ২৫ জন কর্মী রেখেছেন এই তরুণী, যাতে সবাই কিছু আয় করতে পারেন।
সাইদার বেতন ২৫ হাজার আফগানি ছিল। তা কমে এখন ৮ থেকে ১২ হাজারে দাঁড়িয়েছে। যেকোনো সময় পুলিশ বন্ধ করে দিতে পারে—এমন ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে সাইদা বলেন, ‘আমরা লুকিয়ে কাজ করি এবং কত দিন এভাবে চলবে, তা জানি না।’ এই তরুণী বলেন, যখনই সরকার গোপন পারলারের খবর পায়, সব ভেঙে দেয়, কর্মীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার ও জরিমানা করে।