‘সুলতান সুলেমান’ টিভি ধারাবাহিকের পোস্টার
‘সুলতান সুলেমান’ টিভি ধারাবাহিকের পোস্টার

টিভি সিরিজ রপ্তানিতে তুরস্ক এখন বিশ্বে তৃতীয়, কোথায় যাচ্ছে তুর্কি সিরিয়াল

অটোমান ইতিহাসের বড় একটি অংশই সোপ অপেরার মতো। অটোমান শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন ‘ম্যাগনিফিসেন্ট’ হিসেবে পরিচিত সুলতান সুলেমান। ষোড়শ শতকে তিনি যাঁকেই নিজের ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবেছেন, তাঁকেই হত্যা করেছেন। তাঁর এই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ পড়েননি বোনের স্বামী থেকে শুরু করে ছেলে ও নাতি। দুই বোনের স্বামী, দুই পুত্র ও তথাকথিত বিদ্রোহী পুত্রদের ছোট সন্তানদের হত্যা করতে কসুর করেননি তিনি।

২০১১ সালে টিভি সিরিজ সুলতান সুলেমান প্রথম প্রচারিত হয়। তখন সিরিজটি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে—সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এই সিরিজ সম্প্রচারিত হয়। দ্য ইকোনমিস্টের সংবাদে বলা হয়েছে, এই টিভি সিরিজের মধ্য দিয়ে তুরস্কের টিভি সিরিজ বৈশ্বিক পরিসরে জায়গা পেতে শুরু করে।

এর পর থেকে সারা বিশ্বে তুরস্কের টিভি সিরিজের কদর বাড়তে থাকে। এই তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে ‘গাদ্দার’ (ক্ষমাহীন)। এটি এক যুদ্ধফেরত সৈনিকের জীবনকাহিনি, যে নিজের পরিবারকে বাঁচাতে হন্তারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে বাধ্য হয়।

সারা বিশ্বে টেলিভিশন সিরিজ রপ্তানিতে তুরস্কের অবস্থান এখন তৃতীয়, তাদের সামনে কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তুরস্কের টিভি সিরিজের বৈশ্বিক চাহিদা বেড়েছে ১৮৪ শতাংশ। একই সময়ে কোরীয় নাটকের চাহিদা বেড়েছে ৭৩ শতাংশ। তথ্য বিশ্লেষণকারী সংস্থা প্যারট অ্যনালাইটিক্সের সূত্রে এ খবর জানিয়েছে দ্য ইকোনমিস্ট।

তুরস্কের টিভি সিরিজগুলো এখন শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকাতেও জনপ্রিয়। গত বছর যে দেশগুলো তুরস্কের টিভি সিরিজ সবচেয়ে বেশি আমদানি করেছে সেগুলো হলো স্পেন, সৌদি আরব ও মিসর। ইস্তাম্বুল চেম্বার অব কমার্সের প্রাথমিক হিসাব, ২০২২ সালে টিভি সিরিজ রপ্তানি করে ৬০ কোটি ডলার আয় হয়েছে। অনেক বিশ্লেষক বলেছেন, শিগগিরই এই অঙ্ক বিলিয়ন বা শতকোটি ডলার স্পর্শ করবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিক কী কারণে তুরস্কের এই টিভি সিরিজগুলো এত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। দ্য ইকোনমিস্টের সংবাদে বলা হয়েছে, এর একটি কারণ হচ্ছে, এগুলো দেখতে খুব ভালো লাগে বা চোখের জন্য আরামদায়ক। যেখানে এই সিরিজগুলো শুট করা হয়, তার ভূপ্রকৃতি অনিন্দ্যসুন্দর; চরিত্রগুলো যেসব পোশাক-আশাক পরে, সেগুলো বিলাসবহুল এবং সেই সঙ্গে যাঁরা এসব সিরিজে অভিনয় করেন, তাঁরা সুদর্শন। এসব টিভি সিরিজের বেশির ভাগই প্রেমের গল্পকেন্দ্রিক, সায়েন্স ফিকশন নেই বললেই চলে। গল্পের মধ্যে রোমান্স ও প্রতিশোধের মিশেল ঘটানো হয়।

আরব দর্শকদের কাছে তুরস্কের টিভি সিরিজগুলোর জনপ্রিয়তার কারণ হলো, এসব সিরিজে মুসলমানদের নায়ক হিসেবে চিত্রিত করা হয়। হলিউডের ছবিতে যেমন প্রায়ই মুসলমানদের সন্ত্রাসী ও ক্যাব ড্রাইভার হিসেবে দেখানো হয়, তুর্কি সিরিজে সে রকম হয় না। সেই সঙ্গে চরিত্রগুলোর কাছ থেকে তারা যে ভদ্রতা-সভ্যতা আশা করে, সেটাও এই সিরিজগুলোতে রক্ষিত হয়। তুরস্কের মিডিয়া নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো সিরিজে অ্যালকোহলের বোতল দৃশ্য ঝাপসা করে দেয়; সেই সঙ্গে সিরিজগুলোতে যৌন মিলনের দৃশ্য নিষিদ্ধ। শুধু তা-ই নয়, চরিত্রগুলো যদি চুম্বনে আবদ্ধ হয়, তাহলেও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

২০২৩ সালে প্রথম ভাগে স্পেনে যে তিনটি টিভি সিরিজ সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তার সব কটিই তুর্কি। স্পেন ও লাতিন আমেরিকার মানুষদের টেলিনভেলা দেখার ইতিহাস আছে, যার সঙ্গে তুর্কি টিভি সিরিয়ালগুলোর অনেক মিল। যেমন নাটকীয় গল্প, আবেগের তীব্রতা রয়েছে ও বড় বড় পর্ব। ফলে এসব দেশের দর্শকেরা অনায়াসে তুর্কি সিরিজগুলো গ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া পশ্চিমা টেলিভিশন সিরিজগুলোতে যেভাবে যৌনতা ও সহিংসতার দৃশ্যায়ন করা হয়, সেখান থেকে একটু ভিন্ন স্বাদ পেতে এসব দেশের দর্শকেরা তুর্কি সিরিজগুলোর দিকে ঝুঁকছেন।

লাতিন আমেরিকায় এসব তুর্কি সিরিজের জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ হলো, এগুলোর নির্মাণকৌশল। দর্শকদের কাছে লাতিন আমেরিকার টেলিনভেলাগুলো অনেক সময় দেখতে সস্তা সস্তা লাগে, অন্তত তুর্কি সিরিজগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে। এ ছাড়া তুরস্ক ও লাতিন আমেরিকার মানুষেরা সাধারণত নিজেদের অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে রাখঢাক করেন না বলে মনে করেন ইউনিভার্সিটি অব জর্জিয়ার শিক্ষক ক্যারোলিনা অ্যাকস্টা আলজুরু। তিনি মনে করেন, এসব কারণে এ দেশগুলোতে মেলোড্রামার কদর আছে।  

লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে জনপ্রিয়তা পেলেও তুর্কি সিরিজগুলো ইংরেজিভাষী অঞ্চল, যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে খুব একটা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না। দ্য ইকোনমিস্টের সংবাদে বলা হয়েছে, ইংরেজি ভাষায় দর্শকেরা সাধারণত ভাষান্তরিত বা সাবটাইটেল যুক্ত কনটেন্ট দেখতে অভ্যস্ত নন। সে কারণে তুর্কি সিরিজগুলো এসব দেশে তেমন একটা হালি পানি পাচ্ছে না।

‘কারা পাড়া আস্ক’ বা ‘কালো টাকার ভালোবাসা’ নামে একটি সিরিজ ফুটবলার লিওনেল মেসি ও মার্কিন গায়ক বারবারা স্ট্রেইসান্ডের প্রিয় হলেও সে দেশে তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি, যদিও স্পেনের ‘মানি হাইস্ট’ ও দক্ষিণ কোরিয়ার ‘স্কুইড গেম’ যুক্তরাষ্ট্রে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র জয় করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এমনকি তুরস্কের বা অটোমানদের সবচেয়ে উজ্জ্বল শাসক সুলতান সুলেমান আফ্রিকা ও ইউরোপের একাংশ অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে আনতে পারলেও যুক্তরাষ্ট্র তো দূরের কথা, যুক্তরাজ্য পর্যন্ত যেতে পারেননি। সে জন্য তুর্কি সিরিজগুলোর ইংরেজিভাষী মানুষদের জয় করার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা নেই বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।