অর্থনীতিতে নানা অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রি বেড়েছে। এতে বোঝা যায়, মানুষের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এসেছে, তা না হলে অনিশ্চয়তার মধ্যে মানুষ এত বিলাসবহুল গাড়ি কিনত না।
২০২২ সাল ছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতির বছর। রাশিয়ার-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় একদিকে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। সেই ধাক্কায় দাম বাড়ে সবকিছুর। ফলে ২০২২ সালে বছরজুড়ে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকনীতি সুদহার বৃদ্ধি করে। পরিণামে ২০২২ সালের শেষ দিকে দেশে দেশে মন্দাভাব তৈরি হয়। এ বছরও অর্থনীতির অবস্থা ভালো যাবে না বলেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পূর্বাভাষ।
কিন্তু এত এত নেতিবাচক খবরের মধ্যে বিস্ময়কর খবর হচ্ছে, এই মন্দাভাবের মধ্যে বিশ্বের অনেক দেশেই বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রি বেড়েছে। রোলস রয়েস কোম্পানির প্রধান নির্বাহী সিএনবিসিকে বলেছেন, মন্দাভাব সত্ত্বেও গত বছর তাদের রেকর্ড বিক্রি হয়েছে। তাদের গাড়ির মূল্য পাঁচ লাখ ডলারের নিচে নয়।
২০২২ সালে রোলস রোয়েস ৬ হাজার ২১টি গাড়ি বিক্রি করেছে, যা ২০২১ সালের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি। আর ২০২২ সালে এই প্রথম রোলস রয়েসের গাড়ি বিক্রয় বার্ষিক হিসাবে ছয় হাজার ছাড়িয়েছে। তবে বিএমডব্লিউয়ের মালিকানাধীন ব্রিটিশ এই কোম্পানি অবশ্য রাজস্ব ও মুনাফার পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি। তবে এটা জানিয়েছে, গত বছর রোলস রয়েসের গড় দাম ছিল ৫ লাখ ৩৪ হাজার ডলার।
বিশ্বের অনেক দামি ব্র্যান্ডই বলছে, ২০২২ সালের তাদের রেকর্ডসংখ্যক গাড়ি বিক্রি হয়েছে। যুক্তরাজ্যের বিলাসবহুল গাড়ি ব্র্যান্ড বেন্টলি জানিয়েছে, ২০২২ সালে তাদের ১৫ হাজার অতি বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রি হয়েছে। ল্যাম্বারগিনির বিক্রি বেড়েছে ১০ শতাংশ। তাতে ২০২২ সালের তাদের বিক্রীত গাড়িসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ২৩৩। আরেক বিলাসবহুল ব্র্যান্ড বুগাতির বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রির পরিমাণ অবশ্য বেশি নয়—মাত্র ৮০টি। তবে তাদেরও বিক্রির প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এদিকে বিলাসবহুল গাড়ির মধ্যে বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রির হার বেড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহুদিন পর ২০২২ সালে কোনো স্থানীয় কোম্পানির গাড়ি সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে। ফোর্বসের তথ্যানুসারে, গত বছর সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে ইলন মাস্কের কোম্পানি টেসলার গাড়ি। এ ছাড়া রোলডস রয়েসের বিলাসবহুল বৈদ্যুতিক গাড়ি দ্য স্পেকটার ক্যুর প্রত্যাশাতীত বিক্রি হয়েছে।
একই সঙ্গে, ল্যাম্বারগিনির ও বুগাতির মতো বিলাসবহুল গাড়ি কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, তাদের এখন দম ফেলবার ফুরসত নেই। যে বুকিং তাদের আছে, তাতে সেগুলো সরবরাহ করতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত লেগে যাবে। অর্থাৎ, এসব গাড়ির চাহিদা বাড়ছে।
এদিকে ভারতের গাড়ি বিক্রেতাদের সংগঠন সিয়ামের হিসাব, গত বছর দেশটিতে যাত্রীবাহী গাড়ির পাইকারি বিক্রি ছিল ৩৮ লাখ, যা সর্বকালীন রেকর্ড। বাণিজ্যিক গাড়ি বিক্রি হয়েছে ৯ দশমিক ৩ লাখ। এটা আবার ২০১৮ সালের সর্বোচ্চ ব্যবসার চেয়ে প্রায় ৭২ হাজার কম। যাত্রীবাহী বাজার বাড়লেও দেশটির গাড়িশিল্প আগেই জানিয়েছিল, কম দামি ছোট গাড়ির বিক্রি সেই হারে বাড়েনি। বরং সেই তুলনায় ‘স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকল’-এর (এসইউভি) মতো একটু দামি গাড়ির চাহিদা বেশি। ২০২২ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরের পরিসংখ্যানে তা স্পষ্ট।
পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২২ সালে ভারতে বিলাসবহুল গাড়ি, অর্থাৎ দুই কোটি রুপির বেশি দামের গাড়ি রেকর্ড পরিমাণে বিক্রি হয়েছে। এ ধরনের গাড়ি বিক্রির প্রবৃদ্ধির হার ৫০। এর আগে প্রবৃদ্ধির সর্বোচ্চ হার ছিল ২০১৮ সালে। ভারতে ২০২২ সালে ৪৫০ ইউনিট অতি বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রি হয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ বিক্রি হয়েছিল ৩২৫ ইউনিট।
গত বছর দামি গাড়ি বিক্রি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে খাতসংশ্লিষ্ট মানুষেরা মনে করছেন, কোভিডের পর মানুষের মনোভাবে পরিবর্তন এসেছে। আগে দামি গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে ভারতীয়দের মধ্যে এক ধরনের উদাসীনতা কাজ করত। অর্থ থাকলেও মানুষ অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের গাড়ি কিনতে চাইত না। সমাজেও এই প্রবণতা ইতিবাচক হিসেবে স্বীকৃত ছিল। কিন্তু কোভিডের পর মানুষ এখন আর ধনী হয়ে মরতে চায় না, বরং তারা এখন ধনী হিসেবে বাঁচতে চায়। মানুষ এখন জীবন উপভোগ করতে চায়। শুধু গাড়ি কেনা নয়, ব্যক্তিগত জেটা বিমান, প্রমোদতরী কেনা ও বেড়াতে গিয়ে ব্যয় করতে কার্পণ্য না করা—এসব পরিবর্তনও মানুষের জীবনে এসেছে।
বিলাসবহুল গাড়ি যত্রতত্র ঘুরে বেড়ালে ব্র্যান্ডমূল্য যে থাকবে না, তা কোম্পানিগুলো ভালোই জানে। সে জন্য তাদের নীতি হচ্ছে, সীমিত সরবরাহ। যত কম গাড়ি রাস্তায় দেখা যাবে, তত বেশি দাম বাড়বে। পৃথিবীতে যেসব জিনিস অপ্রতুল, তার দাম একটু বেশিই হয়। যেমন, ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত ফেরারির নির্মিত গাড়ির সংখ্যা ২ লাখ ৩০ হাজারের মতো। অথচ স্ট্যাটিসটার মতে, ২০২১ সালে টয়োটা তাদের করোলা মডেলের অন্তত ১১ লাখ গাড়ি বিক্রি করে। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত গাড়ি উৎপাদনকারী ফোর্ড ১৯৬৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে তাদের মাস্টাং মডেলের গাড়ি বিক্রি করেছে ১ কোটির বেশি।