যুদ্ধের পেছনে কত খরচ করছে রাশিয়া

সম্প্রতি মস্কোর ক্রেমলিনে সিনেট ভবনের গম্বুজের কাছে ড্রোন বিস্ফোরিত হয়
ফাইল ছবি: রয়টার্স

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ার একটি স্লোগান ছিল এ রকম: সবকিছু যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য। সম্প্রতি রুশ সরকারের ব্যয় পরিকল্পনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে দেশটির অর্থমন্ত্রী সেই স্লোগানের পুনরাবৃত্তি করেছেন।

রুশ সরকার ইউক্রেন আক্রমণকে এখনো বিশেষ সামরিক অভিযান হিসেবে আখ্যা দেয়। তবে রুশ সরকারের নতুন বাজেট পরিকল্পনা দেখে নিউইয়র্ক টাইমসের মন্তব্য, যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই রাশিয়ার অর্থনীতি পুনর্গঠন করা হচ্ছে।

আগামী বছর রাশিয়ার মোট জাতীয় ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশ বা ১০৯ বিলিয়ন ডলার জাতীয় প্রতিরক্ষায় ব্যয় করা হবে, যে অর্থ হয়তো স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, অবকাঠামো ও অন্যান্য খাতে ব্যয় করা যেত। আরও বড় কথা হলো, রাশিয়ার জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদনের ৬ শতাংশ যুদ্ধের পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া ইউক্রেন অভিযান শুরু করার পর দেশটির অর্থনীতিকে এই নাটকীয় পরিবর্তনের সঙ্গে বিস্ময়কর গতিতে তাল মেলাতে হয়েছে।

যাদের সঙ্গে রাশিয়া বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করেছে, তারা নিষেধাজ্ঞা দিতে শুরু করে। রাশিয়ার বৃহত্তম অর্থনৈতিক অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন খুব দ্রুতই অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। বন্ধ হয়ে যায় রাশিয়ার আয়ের উৎস। আরেক দিকে যুক্তরাষ্ট্র তার আর্থিক সক্ষমতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে—রাশিয়ার শত শত কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত জব্দ করে এবং দেশটিকে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

রাশিয়ার হামলা শুরুর পর ১৯ মাস অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে রাশিয়ার অর্থনীতির চিত্র এখন অনেকটাই মিশ্র প্রকৃতির। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপানোর সময় পশ্চিমা দেশগুলো যেমনটা ভেবেছিল, রাশিয়ার অর্থনীতি বাস্তবে অতটা ভেঙে পড়েনি; বরং তারা যথেষ্ট ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে এখনো ভালোভাবে টিকে আছে।

পশ্চিমারা রাশিয়ার তেল না কিনলেও তেল কেনার খদ্দেরের অভাব হয়নি দেশটির। ফলে দেশটির পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অর্থায়ন করা সম্ভব হয়েছে। দেশটির প্রায় সব শ্রমিকের হাতে এখন কাজ আছে এবং তাঁদের সাপ্তাহিক মজুরি বেড়েছে। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর দেশটির প্রবৃদ্ধি হতে পারে ২ দশমিক ৫ শতাংশ; অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রকেও প্রবৃদ্ধির হারের দিক থেকে ছাড়িয়ে যাবে রাশিয়া।

এটাই গল্পের পুরোটা নয়, বাকি আছে আরও। ব্যাংক অব ফিনল্যান্ড ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস ইন ট্রানজিশনের পরামর্শক লরা সোলাঙ্কো বলেছেন, কোনো দেশ যখন যুদ্ধে যায়, তখন মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি দিয়ে তার পরিস্থিতি ভালোভাবে বোঝা যায় না; বরং যুদ্ধের সময় অর্থনীতি বিচারের জন্য মানদণ্ড হিসেবে জিডিপি যথেষ্ট দুর্বল। কারণ হচ্ছে, যুদ্ধের সময় প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উৎপাদন করতে হয়, ফলে জিডিপি বাড়তে পারে; কিন্তু মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হয় না।

আবার পণ্য আমদানি করতে বা নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে ডলারসহ বিদেশি মুদ্রার চাহিদা বাড়ছে। এ কারণে গত সপ্তাহে রাশিয়ার মুদ্রা রুবেলের মান ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যায়, অর্থাৎ তাৎপর্যপূর্ণভাবে ডলারের বিপরীতে রুবেলের মান ১০০ ছাড়িয়ে যায়।

সরকারি ব্যয় ও ঋণ বৃদ্ধির কারণে চাপের মুখে থাকা অর্থনীতি আরও চাপের মুখে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্রুততার সঙ্গে নীতি সুদহার ১৩ শতাংশে উন্নীত করেছে। মূল্যস্ফীতির রাশ টানতেই এই উদ্যোগ। নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি মানুষের পক্ষে ঋণ করা আরও কঠিন হবে, আর তাতে প্রবৃদ্ধির গতি কমে আসবে।

অন্যদিকে রাশিয়ার ভোক্তারাও চাপের মুখে পড়েছেন। মাখন, মাংস—এমনকি রুটির দাম বেড়ে গেছে। এ ছাড়া রাশিয়া বিপুল পরিমাণে ভোগ্যপণ্য আমদানি করে—টেলিফোন থেকে শুরু করে ওয়াশিং মেশিন, গাড়ি, ওষুধ, কফি—এমন আরও অনেক কিছু তাকে আমদানি করতে হয়। তাই রুবলের দরপতনের কারণে ভোক্তারা চাপের মুখেই পড়ছেন।

আগামী মার্চ মাসের রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই পরিস্থিতিতে ভ্লাদিমির পুতিন স্বীকার করেছেন, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ও দুর্বল রুবল বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। ব্যয়ের রাশ টানতে সরকারের পক্ষে হয়তো নির্বাচনের আগে সামাজিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা সম্ভব না-ও হতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার বাজেটের বড় একটি অংশ যুদ্ধ খাতে চলে যাচ্ছে। বাজেট থেকে অতিরিক্ত ৯ দশমিক ২ শতাংশ জাতীয় নিরাপত্তা খাতে ব্যয় করা হচ্ছে, যার মধ্যে আইন প্রয়োগের বিষয় আছে। যুদ্ধে যাঁরা আহত বা নিহত হচ্ছেন, তাঁদের ক্ষতিপূরণে বড় একটি অঙ্ক ব্যয় করতে হচ্ছে। আবার নতুন অধিকৃত অঞ্চলগুলোকে আত্তীকরণ করতেও অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে রাশিয়াকে।