আগামী শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক নির্বাচন। ভারতের ১৪০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৯৬ কোটি মানুষ ভোটার। এক মাস ধরে চলবে এই ভোট উৎসব। ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টানা তৃতীয়বার নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন—ঘটনাটি বিরল।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারত ২১ শতকের অর্থনৈতিক পরাশক্তি হতে যাচ্ছে। তারা এখন প্রকৃত অর্থেই চীনের বিকল্প হতে চাইছে। বিভিন্ন কারণে পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলোর চীন ছাড়ার যে হিড়িক শুরু হয়েছে, তাদেরকে বিনিয়োগের বিকল্প ক্ষেত্র দেওয়ার চেষ্টা করছে দেশটি।
পশ্চিমের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ক্রমেই খারাপ হচ্ছে, যদিও ভারতের সঙ্গে বিশ্বের প্রায় সব বড় অর্থনীতির সম্পর্ক ভালো। দেশটি আগ্রাসীভাবে বিশ্বের বড় সব কোম্পানিকে কারখানা স্থাপনে আহ্বান জানাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে মোদির ভারত নিয়ে যে অতিমাত্রায় প্রচারণা চলছে, তার যৌক্তিকতা কতটা? বিশেষ করে দেশটির বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনো যেহেতু দরিদ্র।
এমনকি ভারতের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের নির্ভরযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। ফলে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশের প্রকৃত অবস্থা কী, তা মূল্যায়ন করা কঠিন।
তবে সরকারি ও অন্যান্য দাপ্তরিক তথ্য বিশ্লেষণ করে সিএনএন দেখিয়েছে, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর ভারত কেমন করেছে। সেই সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল এই অর্থনীতি ভবিষ্যতে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে, তা নিয়েও পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।
২০২৩ সালের ভারতের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির আকার ছিল ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন বা ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলার। ফলে দেশটি এখন বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি; মোদি ক্ষমতায় আসার পর ভারত এ ক্ষেত্রে চার ধাপ এগিয়েছে।
আগামী কয়েক বছরে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্তত ৬ শতাংশের ঘরে থাকবে। যদিও বিশ্লেষকেরা মনে করেন, অর্থনৈতিক পরাশক্তি হতে ভারতকে ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে।
দীর্ঘদিন উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করলে ভারত বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির কাতারে আরও কয়েক ধাপ উঠে যাবে। অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, ২০২৭ সালের মধ্যে ভারত যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির তকমা অর্জন করবে।
বর্তমানে পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হলেও মাথাপিছু জিডিপিতে ভারত এখনো অনেক পিছিয়ে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, মাথাপিছু জিডিপিতে ভারত এখন বিশ্বের ১৪৭তম দেশ।
সুইজারল্যান্ডের সেন্ট গ্যালেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামষ্টিক অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক গুইডো কোজ্জি বলেন, ভারতের অর্থনীতি যত বাড়বে, চুইয়ে পড়া তত্ত্বের আলোকে সে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বা জিডিপিও বাড়বে। একই সঙ্গে তাঁর সতর্কবাণী, এই চুইয়ে পড়া তত্ত্ব দিয়ে যে অসমতা হ্রাস করা যাবে, তার নিশ্চয়তা নেই। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে—এমন নীতি প্রণয়ন জরুরি বলে তিনি মনে করেন।
তিন দশক আগে চীন যে কাজে হাত দিয়েছিল, ভারত এখন সেই কাজ শুরু করেছে। অর্থাৎ দেশটি এখন অবকাঠামো খাতে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে—রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে, বন্দর, বিমানবন্দর ও রেলওয়ে খাতে বিপুল কর্মযজ্ঞ চলছে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের উদ্যোগে সেখানে বিশ্বের বৃহত্তম পরিবেশবান্ধব জ্বালানি কারখানা হচ্ছে।
নতুন বছরের বাজেটে কেবল অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ নিশ্চিত করতে ভারত ১৩৪ বিলিয়ন ডলার বা ১৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
ভারতের দিকে তাকালে এই বরাদ্দের সত্যতা মিলবে। ২০১৪ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে জাতীয় মহাসড়ক নেটওয়ার্কে প্রায় ৫৫ হাজার কিলোমিটার নতুন সড়ক যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ এই সময়ে দেশটির জাতীয় মহাসড়ক বেড়েছে ৬০ শতাংশ। অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রভাব অর্থনীতিতে নানাভাবেই অনুভূত হয়, কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে ‘সহজ ব্যবসার’ সূচকে উন্নতি ঘটাতে এর প্রয়োজনীয়তা আছে।
সম্প্রতি ভারত বেশ কিছু প্রযুক্তিগত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে, যা ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার নামে পরিচিত। এর মধ্য দিয়ে মানুষের জীবন ও ব্যবসা–বাণিজ্য বদলে যাচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সফলতা হলো আধার কার্ড। ২০০৯ সালে প্রবর্তিত এই কার্ডের মধ্য দিয়ে কোটি কোটি ভারতীয় নাগরিক জীবনে এই প্রথম ডিজিটাল পরিচিতি পেয়েছে। বিশাল এই বায়োমেট্রিক তথ্যভান্ডারের কল্যাণে ভারত সরকারের পক্ষে দুর্নীতির রাশ টেনে ধরাও সম্ভব হয়েছে অনেকটা।
আরেকটি প্ল্যাটফর্ম হলো ইউনিফায়েড পেমেন্ট ইন্টারফেস। এই ব্যবস্থার কল্যাণে তাৎক্ষণিকভাবে কিউআর কোড স্ক্যান করে অর্থ পরিশোধ করা যায়। এই ব্যবস্থা ভারতের সব স্তরের মানুষের মনে ধরেছে, রাস্তার ভিক্ষুক থেকে শুরু করে কফির দোকানের মালিক—সবাই এখন এটি ব্যবহার করছেন। ফলে কোটি কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ এখন আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে প্রবেশ করছে।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনের সূত্রে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ভারত মাত্র ছয় বছরে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে; ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম না থাকলে যা অর্জনে হয়তো ৪৭ বছর লেগে যেত।
ভারতের শেয়ারবাজারও গত কয়েক বছরে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শেয়ারবাজারের কাতারে ঢুকেছে। এই স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধন এখন ৪ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন বা ৪ লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলার। দেশটির শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসছেন। ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচনের পর সেখানে আরও অনেক বিদেশি বিনিয়োগ আসবে।
পশ্চিমাদের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব–সংঘাত ও পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর সরবরাহব্যবস্থার বহুমুখীকরণের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে ভারত। উৎপাদন খাতে প্রণোদনা দিতে তারা ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের বরাদ্দ দিয়েছে। ইলেকট্রনিকস থেকে শুরু করে অটোমোবাইল, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদনে প্রণোদনা দিতে এই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে অ্যাপল ভারতে কারখানা করেছে; তাদের কার্যক্রম আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে। ইলন মাস্কের টেসলাও ভারতে কারখানা করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
এত কিছু সত্ত্বেও ভারতের অর্থনীতি দেশটির গণতন্ত্রের মতোই; মোটেও নিখুঁত নয়। দেশটির মানুষের গড় বয়স ২৯ বছর। অর্থাৎ জনসংখ্যাগত সুবিধা বা জনমিতির সুবিধা পাচ্ছে তারা; কিন্তু দেশটিতে তরুণদের বেকারত্বের হার বৈশ্বিক গড় হারের চেয়ে বেশি। এসব সমস্যা মোকাবিলা করেই দেশটিকে এগোতে হবে।