ব্রিকস মুদ্রা কী, বাস্তবতা কতটা আর দেশগুলোই বা কী ভাবছে

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বিশ্বাস করেন না যে ডলার ব্যবহার করে না, এমন দেশগুলোকে বাণিজ্যে ডলার ব্যবহারে বাধ্য করা উচিত।

ব্রিকস সম্মেলন মঞ্চে (বাঁ থেকে) ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাও। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের স্যান্ডটন সম্মেলন কেন্দ্রে

পাঁচ বিকাশমান অর্থনীতির জোট ব্রিকসের চলমান শীর্ষ সম্মেলনে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের জন্য নিজস্ব মুদ্রা চালুর আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর যুক্তি, ডলারের বিনিময় হার সব সময়ই ওঠানামা করে, তাই ব্রিকসের সদস্যদেশগুলো একটি নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন করতে পারে।

দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকসের এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে ব্রিকসের মতো একটি জোটের জন্য মুদ্রা চালু করা খুব সহজ বিষয় নয়। এ ধরনের প্রকল্পে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে, সে বিষয়ে আলো ফেলেছেন ব্রিকসের কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবিদেরা।

বিশেষ করে, ব্রিকসভুক্ত ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পার্থক্যের প্রেক্ষাপটে।

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বিশ্বাস করেন না যে ডলার ব্যবহার করে না, এমন দেশগুলোকে বাণিজ্যে ডলার ব্যবহারে বাধ্য করা উচিত। এ ছাড়া তিনি দক্ষিণ আমেরিকার মারকোসুর ব্লকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যেও অভিন্ন মুদ্রা ব্যবহারের কথা বলেন।

ব্রিকস সম্মেলনের প্লেনারি অধিবেশনে তিনি বলেন, ‘ব্রিকসের মুদ্রা থাকলে আমাদের যেমন অর্থ পরিশোধের নানা পথ তৈরি হবে, তেমনি আমাদের অনিশ্চয়তাও কমবে।’
কিন্তু অন্য ব্রিকস নেতারা কী ভাবছেন?

দক্ষিণ আফ্রিকার নেতারা অবশ্য বলেছেন, ব্রিকস মুদ্রা এবারের সম্মেলনের আলোচ্য সূচিতে নেই। এর আগে গত জুলাইয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ব্রিকস মুদ্রা চালুর চিন্তা নেই। এ ছাড়া দেশটির পররাষ্ট্রসচিব সম্মেলনের উদ্দেশে দেশ ত্যাগের আগে বলেন, সম্মেলনে নিজেদের মুদ্রায় ব্যবসা-বাণিজ্য করা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হবে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে বলেছেন, ডলারের বিপরীতে জাতীয় মুদ্রায় ব্যবসা-বাণিজ্য করা যায় কি না, সে বিষয়ে আলোচনা হবে।
চীন অবশ্য এ বিষয়ে মন্তব্য করেনি। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং মূলত আন্তর্জাতিক আর্থিক ও মুদ্রাব্যবস্থা সংস্কারের প্রসঙ্গে আলোচনা করেন।

চ্যালেঞ্জ কী

ব্রিকসের মুদ্রা চালু করার বিষয়টি ‘নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক প্রকল্প’। দক্ষিণ আফ্রিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর লেসেৎজা কগাইনগো জুলাইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার এক রেডিও স্টেশনকে এ কথা বলেন।

কগাইনগো আরও বলেন, ‘অভিন্ন মুদ্রা চালু করতে হলে আপনার ব্যাংকিং ইউনিয়ন প্রয়োজন হবে, সেই সঙ্গে প্রয়োজন রাজস্ব ইউনিয়ন ও সামষ্টিক অর্থনীতির একীভবন।’
এ ছাড়া আরও কিছু প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন দক্ষিণ আফ্রিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। যেমন ব্রিকস মুদ্রা চালু হওয়ার পর কোনো দেশ যদি নিয়ম লঙ্ঘন করে, তাহলে তাদের পথে আনার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ ছাড়া প্রয়োজন হবে অভিন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ঠিক করতে হবে সেই ব্যাংক কোথায় থাকবে।

এর বাইরে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর মধ্যকার বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা থাকার কারণেও অভিন্ন মুদ্রা চালু করা কঠিন বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। ব্রিকসের সব দেশের মূল বাণিজ্য অংশীদার হচ্ছে চীন, কিন্তু বাকি দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য খুবই কম।

ডলার কি বিপদে

গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মূল্যস্ফীতি লাগামছাড়া হয়ে যায়। রাশ টানতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভসহ অনেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে এবং পরিণামে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যায়। সে কারণে অনেক দেশ এখন ডলার পাশ কাটিয়ে ভিন্ন মুদ্রায় বাণিজ্যের চেষ্টা করছে।

এ ছাড়া যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়াকে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। সে কারণেও অনেকের মনেই এই প্রত্যয় হয় যে বিশ্বের অনেক দেশ, বিশেষ করে, যারা পশ্চিমাদের মিত্র নয়, তারা ডলার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
এ বিষয়ে সম্মেলনে পুতিন বলেছেন, ডি-ডলারাইজেশন প্রক্রিয়া গতি পেয়েছে, এটাকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব অনুসারে, ২০২২ সালে বৈশ্বিক রিজার্ভে ডলারের পরিমাণ ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমে এসেছে, যা ৫৮ শতাংশ। বিনিময় হার সমন্বয়ের পর দেখা যায়, তা কার্যত ৪৭ শতাংশ।

এরপরও বিশ্ব বাণিজ্যে এখনো ডলারে আধিপত্য চলছে। ব্যাংক অব ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টসের তথ্যানুসারে, বিশ্বে যত বিদেশি মুদ্রা লেনদেন হয়, তার ৯০ শতাংশ এখনো ডলারে হয়।

ডি–ডলারাইজেশনের প্রক্রিয়াকে যদি সত্যিই এগিয়ে নিতে হয়, তাহলে বিশ্বের অগণিত আমদানিকারক, রপ্তানিকারক, ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতাদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা ডলারের পরিবর্তে অন্য মুদ্রা ব্যবহার করবে।