বিশ্ববাজারে সোনার দাম বাড়ার কারণ কী

স্বর্ণের বার
ফাইল ছবি

বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সোনা কেনা বাড়িয়েছে। ২০২২ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ১ হাজার ১৩৬ টন সোনা মজুত করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৪৫০ টন বেশি।

ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্টের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সোনা মজুতের এ পরিমাণ ১৯৬৭ সালের পর সর্বোচ্চ।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, গত এক মাসে বিশ্ববাজারে সোনার দাম আউন্সপ্রতি ১৪৭ ডলার বেড়ে যাওয়ার পেছনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ভূমিকা আছে।

গোল্ড প্রাইস ডট অর্গের তথ্যানুসারে, আজ সকালে অবশ্য সোনার দাম কিছুটা কমেছে। আউন্সপ্রতি ৯২ সেন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৮৭ সেন্ট। তবে সামগ্রিকভাবে সোনার দাম গত ছয় মাসে ৩২২ ডলার বেড়েছে।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের জ্যেষ্ঠ বাজারবিশ্লেষক লুইস স্ট্রিট বলেন, বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নিরাপদ সম্পদ হিসেবে বেশি পরিমাণ সোনা মজুতের ওপর জোর দিচ্ছে। এ কারণে সোনা কেনার পরিমাণও বেড়েছে। গত বছর ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ সোনা কিনেছে, তা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।

সেই সঙ্গে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সোনা কেনা বাড়িয়েছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।

২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি সোনা কিনেছে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্টের তথ্যানুসারে, ২০২২ সালে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৪৮ মেট্রিক টন সোনা কিনেছে। এরপরই আছে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তারা কিনেছে ৬২ মেট্রিক টন। এরপর আছে যথাক্রমে মিসর, কাতার, ইরাক, ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। তারা কিনেছে যথাক্রমে ৪৭, ৩৩, ৩৪, ৩৩ ও ২৫ মেট্রিক টন সোনা।

তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, গত বছর বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যত সোনা কিনেছে, তার দুই-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ ৭৪১ টন সোনা বিক্রির রেকর্ড নেই। কোন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব কিনেছে, তার নথি নেই।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীন ও রাশিয়ার মতো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সম্ভবত এই সোনা কিনেছে। মূলত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে থোড়াই কেয়ার করে বিশ্ব বাণিজ্যকে ডলারের জোয়াল থেকে বাঁচানোর জন্য তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড
একসময় মুদ্রা ছাপানো হতো সোনার মজুতের সাপেক্ষে। ১৮৮০ থেকে ১৯১৪ সাল ছিল গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের স্বর্ণযুগ। এ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো তাদের মুদ্রার মান নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ হিসাবে প্রকাশ করে। স্বর্ণমান ব্যবস্থাটি হলো অনেকটা এমন—এখনকার টাকায় লেখা থাকে, চাহিবামাত্র এর বাহককে অত টাকা দিতে বাধ্য থাকিব। মুদ্রাব্যবস্থার ক্ষেত্রে ভিত্তি হলো স্বর্ণমান। বলা যায়, ৫০০ টাকার নোটে অঙ্গীকার থাকত, চাহিবামাত্র এর বাহককে ২৯ গ্রাম স্বর্ণ দিতে বাধ্য থাকিব—এ ধরনের কিছু।

এ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই ব্যবস্থায় চাইলেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোট ছাপাতে পারত না। যেসব দেশ গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল, তারা তাদের দেশীয় মুদ্রার মূল্য কী পরিমাণ স্বর্ণের সমান হবে, তা আইন করে বেঁধে দিয়েছিল। যেমন এক পাউন্ড, এক ডলার, এক জার্মান মার্কের বিনিময়ে কতটুকু স্বর্ণ আদান–প্রদান করা যাবে, তা সেসব দেশের আইনে নির্ধারণ করে দেওয়া হতো। এ ব্যবস্থায় বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মানের বিনিময় হার বা এক্সচেঞ্জ রেটের ওঠানামার খুব একটা বেশি সুযোগ ছিল না। খাঁটি গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড আমলে কাগুজে মুদ্রার বিপরীতে শতকরা ১০০ ভাগ স্বর্ণ রিজার্ভ রাখার বিধান রাখা হয়।

এতে হলো কী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেই মুদ্রা ছাপাতে পারত না। এরপর ১৯৩০-এর দশকের অর্থনৈতিক মন্দা ও দুটি বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত মোকাবিলায় ১৯৪৪ সালে ৪৪টি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ব্রেটন উডস শহরে আলোচনায় মিলিত হয়। সে সময় একটা চুক্তি করে তারা। সিদ্ধান্ত হয়, এসব দেশের মুদ্রার বিনিময়মূল্য নির্ধারিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের ওপর ভিত্তি করে। আর ডলারের মূল্য নির্ধারিত হবে তখন সোনার ওপর ভিত্তি করে। ১৯৪৭ সালে বিশ্বের মোট মজুত করা সোনার ৭০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বিপুল সোনা মজুত ও ডলারের মূল্য স্থিতিশীল থাকায় সেসব দেশ তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ কারেন্সি (মুদ্রা) হিসেবে ডলার সংরক্ষণে একমত হয়।

কিন্তু ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো এবং জাপানের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। তারা ডলার দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সোনা কিনতে থাকে। কমতে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের সোনার মজুত। এর ওপর আবার ভিয়েতনাম যুদ্ধে ব্যয় মেটানোর চাপে ওয়াশিংটন বিপুল পরিমাণ কাগুজে মুদ্রা ছাপাতে শুরু করে। কঠিন হয়ে পড়ে ডলারের সঙ্গে সোনার সংযোগ বজায় রাখা।

এরপর ১৯৭১ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ঘোষণা দেন, সোনার ওপর ভিত্তি করে ডলারের মূল্য আর নির্ধারিত হবে না। সেই থেকে সোনার মজুতে গুরুত্ব কমতে থাকে, যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সোনার মজুত একেবারে বন্ধ করে দেয় না। রিজার্ভ ডলারসহ অন্যান্য মুদ্রার সঙ্গে সোনাও থাকল।

সোনার গুরুত্ব আবার বাড়ল কবে
ডলারের বাড়বাড়ন্তের যুগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সোনার সবচেয়ে বড় বিক্রেতায় পরিণত হয়। তারা যত সোনা কিনত, তার চেয়ে বিক্রিই করত বেশি। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘ দিন সোনার দামে নিম্নমুখী প্রবণতা থাকায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

কিন্তু ১৯৯৭ সালে এশীয় আর্থিক সংকটের পর থেকে পরিস্থিতি ঘুরে যেতে শুরু করে। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো উপলব্ধি করে, সোনার মজুত আবার বাড়াতে হবে।

দেখা যায়, ১৯৯৯ সাল থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সোনা কেনার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ১৯৯৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সোনা কিনেছে রাশিয়া। এ সময় তারা সোনা কিনেছে ১ হাজার ৮৮৮ মেট্রিক টন। চীন কিনেছে ১ হাজার ৫৫২ মেট্রিক টন; তুরস্ক কিনেছে ৫৪১ মেট্রিক টন, ভারত কিনেছে ৩৯৫ মেট্রিক টন। কাজাখস্তান কিনেছে ৩৪৫ মেট্রিক টন, উজবেকিস্তান কিনেছে ৩১১ মেট্রিক টন, সৌদি আরব কিনেছে ১৮০ মেট্রিক টন, থাইল্যান্ড, পোল্যান্ড ও মেক্সিকো কিনেছে যথাক্রমে ১৬৮, ১২৮ ও ১১৫ মেট্রিক টন।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ভূরাজনৈতিক কারণেও কিছু দেশ সোনার মজুত বাড়িয়েছে, যেমন রাশিয়া ও চীন। গত দুই দশকে তারাই সবচেয়ে বেশি সোনা কিনেছে। মূলত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের আধিপত্য ক্ষুণ্ন করতেই তারা এ সিদ্ধান্ত নেয়। আর রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া অধিগ্রহণের পর পশ্চিমাদের যে নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়, তারপর সোনা কেনা বৃদ্ধি করে।

আরেকটি বিষয় হলো, ১৯৯৯ সাল থেকে যেসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবচেয়ে বেশি সোনা কিনেছে, তারা সবাই উদীয়মান বা উন্নয়নশীল দেশ। মূলত আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার নানা অভিঘাত থেকে রক্ষা পেতে তারা সোনার দিকে ঝুঁকেছে।

মোদ্দাকথা হলো, বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলে মানুষ সাধারণত নিরাপদ বিনিয়োগমাধ্যম খোঁজে। সে জন্য গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যায়। সে সময় সোনার দাম স্থিতিশীল ছিল।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক বন্ধের ঘটনায় ফেডারেল রিজার্ভ হয়তো আপাতত নীতি সুদ বৃদ্ধির জায়গা থেকে সরে আসবে। ফলে মার্কিন ডলারভিত্তিক বন্ডের সুদহার কমবে। এই বাস্তবতায় এবার যখন ডলারের উত্তাপ কমতে শুরু করেছে, তখন মানুষ আবার সোনার দিকে ঝুঁকছে।