যুক্তরাষ্ট্র-চীনের প্রযুক্তিযুদ্ধ আরও জোরদার হয়েছে। চিপের যেসব প্রযুক্তি বিনা মূল্যে পাওয়া যায় এবং যেগুলো চীনে বহুল ব্যবহৃত হয়, সেসব প্রযুক্তি নিয়ে মার্কিন কোম্পানিগুলো যেন কাজ না করে, সে বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে চাপ দিচ্ছেন দেশটির আইনপ্রণেতারা। এই পদক্ষেপের ফলে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিশিল্পের পারস্পরিক সহযোগিতা ব্যাহত হতে পারে।
রয়টার্স জানায়, আরআইএসসি-ভি, যার উচ্চারণ রিস্ক ফাইভ, একটি ওপেনসোর্স প্রযুক্তি। এটি ব্রিটিশ সেমিকন্ডাক্টর ও সফটওয়্যার ডিজাইন কোম্পানি আর্ম হোল্ডিংসের তৈরি দামি চিপের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। এই চিপ স্মার্টফোন থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য উন্নত প্রসেসর তৈরির মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন রিপাবলিকান সিনেটর মার্কো রুবিও ও ডেমোক্রেটিক সিনেটর মার্ক ওয়ার্নার, জাতীয় নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে রিস্ক ফাইভ চিপের রপ্তানির বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনকে আরও সচেতন হতে জোর দিচ্ছেন।
আইনপ্রণেতাদের উদ্বেগ, যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর মধ্যকার উন্মুক্ত সহযোগিতার সংস্কৃতির সুযোগ নিয়ে নিজ দেশের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পকে এগিয়ে নিতে পারে চীন। এতে চিপ তৈরির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব ক্ষুণ্ন হতে পারে এবং সেই সঙ্গে চীন এটা কাজে লাগিয়ে সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন করতে পারে। তাদের এই অবস্থান থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো আরআইএসসি-ভি চিপ তৈরির ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাধার মুখে পড়তে যাচ্ছে।
চায়না হাউস সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান মাইক গ্যালাঘার বলেছেন, রিস্ক ফাইভ প্রযুক্তি নিয়ে কোনো মার্কিন নাগরিক বা কোম্পানি চীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে গেলে তাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অতিরিক্ত লাইসেন্স নেওয়ার বিধান করতে হবে।
এর মধ্য দিয়ে মার্কিন-চীন প্রযুক্তিযুদ্ধ আরও তীব্রতা পাবে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র চীনে প্রযুক্তি রপ্তানির ওপর গণহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে দুই দেশের মধ্যে প্রযুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বাইডেন প্রশাসন সম্প্রতি চীনকে জানিয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞা হালনাগাদ করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান মাইকেল ম্যাককল রয়টার্সকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, সিসিপি (চীনা কমিউনিস্ট পার্টি) রিস্ক ফাইভ চিপপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে চিপপ্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য ক্ষুণ্ন করতে চাইছে। তাঁর মতে, চীন প্রযুক্তি স্থানান্তরের যে কৌশল করছে, তাতে সহায়তা করা মার্কিন নাগরিকদের উচিত হবে না।
মাইকেল ম্যাককল বলেন, এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যাদের কাজ হচ্ছে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ দেখভাল করা, সেই ব্যুরো অব ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড সিকিউরিটির পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। যদি তা না হয়, তাহলে আইন অনুসরণ করার কথা বলেন তিনি।
রয়টার্সকে দেওয়া বিবৃতিতে মার্কো রুবিও বলেছেন, ‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ও চিপশিল্পের বিকাশে ওপেনসোর্স চিপ আর্কিটেকচার তৈরি করেছে চীন। যুক্তরাষ্ট্র যদি এই হুমকিকে গুরুত্ব না দেয় বা রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ না করে, তাহলে চীন একদিন চিপ তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে।’
সিনেটর মার্ক ওয়ার্নার রয়টার্সকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি-নিয়ন্ত্রণ আইন ওপেনসোর্স সফটওয়্যারগুলোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক অলাভজনক ফাউন্ডেশন দ্বারা আরআইএসসি-ভি প্রযুক্তি পরিচালিত হয়। ফাউন্ডেশন নিজে অলাভজনক হলেও যারা মুনাফার জন্য কাজ করে, তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে।
আরআইএসসি-ভি প্রযুক্তিটি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে ল্যাবে তৈরি হয়েছে। পরবর্তীকালে এই প্রযুক্তিতে অর্থায়ন করেছে পেন্টাগনের ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি বা ডারপা। নির্মাতারা এটিকে ইথারনেট, ইউএসবি ও এমনকি ইন্টারনেটের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যা খুবই সহজলভ্য। এই উদ্ভাবন দ্রুত ও সহজলভ্য করতে জন্য সারা বিশ্বের মানুষ ভূমিকা রাখতে পারে।
চীনের হুয়াওয়ে টেকনোলজিসের নির্বাহীরা আরআইএসসি-ভি–কে নিজ দেশের চিপ বিকাশের ক্ষেত্রে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এই প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করতে চিপের জগতের মহিরুহ কোয়ালকমের সঙ্গে কাজ শুরু করেছে। জনপ্রিয় মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম অ্যান্ড্রয়েড যাতে আরআইএসসি-ভি চিপেও কাজ করে, সে লক্ষ্যে অ্যালফাবেট চেষ্টা করবে বলে জানিয়েছে।
এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে কোয়ালকম। তবে কোম্পানিটির নির্বাহীরা আগস্টে বলেছিলেন, তাঁরা বিশ্বাস করেন আরআইএসসি-ভি চিপ উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তিশিল্পের রূপান্তরে গতি আনবে। গুগলও এ বিষয়ে মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।
রয়টার্স বলছে, আইনপ্রণেতারা যেভাবে চাইছেন, বাইডেন প্রশাসন যদি সেভাবে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ফাউন্ডেশনে মার্কিন কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণ নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে উন্মুক্ত প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মার্কিন ও চীনা কোম্পানিগুলোর একসঙ্গে কাজ করার পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে। এতে চীন যে চিপ নির্মাণে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চাইছে, তা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সস্তা ও বহুমুখী চিপ তৈরির প্রচেষ্টা ব্যাহত হতে পারে।