তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম খোলাবাজারে কমতির দিকে। এলএনজির দাম প্রতি ইউনিট ২৫ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। বিশ্ববাজারে এখন প্রতি এমএমবিটিইউ (মিলিয়ন মেট্রিক ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) এলএনজির দাম ২২-২৩ ডলার। অথচ ২০২২ সালের ২৫ আগস্ট বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম সর্বোচ্চ ৭০ ডলারে উঠেছিল।
আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট অয়েল প্রাইস ডটকম বলছে, ইউরোপে এখন গ্যাসের মজুত ভালো। সে কারণে বৈশ্বিক চাহিদা কমে আসছে। দামও কমতির দিকে।
২০২২ সালে সারা বিশ্বে এলএনজি আমদানি হয় ৪০৯ মিলিয়ন টন২০২১ সালে আমদানি হয় ৩৮৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন
বিষয়টি হলো, চলতি শীত মৌসুমে ইউরোপের তাপমাত্রা অতটা কমেনি। অয়েল প্রাইসের ভাষ্যমতে, এবার ইউরোপের তাপমাত্রা ‘এক্সেপশনালি লো’। অর্থাৎ এবারের তাপমাত্রা যে খুব একটা কমেনি, তা ব্যতিক্রমী ঘটনা। মহাদেশটিতে গ্যাসের চাহিদা অতটা বাড়েনি। সে কারণে ইউরোপের গ্যাস মজুত রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। শীতকালের অর্ধেক কেটে গেছে, এই পরিস্থিতিতে ইউরোপের তাপমাত্রা আর তেমন একটা না কমলে চাহিদা বাড়বে না। ফলে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এখন আরও বেশি করে এলএনজি আমদানি করতে পারবে বলে তারা মনে করছে।
২০২২ সালের শুরুতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে পশ্চিমারা রাশিয়ার তেল-গ্যাস আমদানি সীমিত করে। রাশিয়ার তেল কেনা অব্যাহত রাখলেও ইউরোপ পাইপলাইনে রাশিয়ার গ্যাস নেওয়া একপ্রকার বন্ধ করে দেয়, যদিও রাশিয়ার কাছ থেকে তারা এলএনজি কিনছে। সেই সঙ্গে রাশিয়ার তেল-গ্যাসে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তারা। বিশ্ববাজারে এলএনজিসহ জ্বালানি তেলের দাম অনেকটা বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পায় মার্কিন ডলারের বিনিময়মূল্য। বিপদে পড়ে জ্বালানি আমদানিকারী দেশগুলো। আমদানি ব্যয় এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে গেলে তাদের রিজার্ভ কমতে শুরু করে। বাংলাদেশের মতো আমদানিকারী দেশগুলো জ্বালানি আমদানি সীমিত করে। এতে কমে যায় বিদ্যুৎ উৎপাদন, দেশে শুরু হয় লোডশেডিং।
গত বছর বিশ্ববাজারে এলএনজির মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ হলো, নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনে ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ হ্রাস এবং একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া-ইউরোপের চাপানউতোরের পর গত সেপ্টেম্বরে রাশিয়া শেষমেশ নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইন বন্ধ করে দেয়। রাশিয়া বলে, ইউরোপের নিষেধাজ্ঞার কারণে পাইপলাইন সারানো যাচ্ছে না। যুদ্ধ শুরুর পর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ পাইপলাইন বেশ কয়েকবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে তথ্য বিশ্লেষণকারী সংস্থা রেফিনিটিভের সূত্রে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে সারা বিশ্বে এলএনজি আমদানি হয় ৪০৯ মিলিয়ন টন, আগের বছর ২০২১ সালে যা ছিল ৩৮৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন। তবে কেপলারের তথ্যানুসারে, এর পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৪০০ দশমিক ৫ ও ৩৭৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন টন। এই বর্ধিত চাহিদার বড় একটি অংশ জোগান দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
পাইপলাইনে রাশিয়ার গ্যাস না নিলেও ইউরোপ রাশিয়ার কাছ থেকে গত বছর রেকর্ড পরিমাণে এলএনজি আমদানি করেছে। ২০২২ সালে রাশিয়া থেকে ইউরোপ এলএনজি নিয়েছে ১৫ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন টন, আগের বছর যা ছিল ১৩ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন টন।
ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার অপরিশোধিত জ্বালানি তেল, পরিশোধিত জ্বালানি ও কয়লা আমদানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও কেবল যুক্তরাজ্য, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া ও লাটভিয়া রাশিয়া থেকে এলএনজি আমদানি স্থগিত করেছে। গোপনে অনেক দেশই তা আমদানি করছে। বাস্তবতা হলো, ইউরোপের পক্ষে রাশিয়ার এলএনজি নেওয়া বন্ধ করা বা কমানোও কঠিন।
ইউরোপের চাহিদার পাশাপাশি গত বছর এশিয়ার বড় দেশ জাপানের এলএনজি চাহিদা বেড়ে যায়। তবে চীনের বেশির ভাগ জায়গায় গত বছরও লকডাউন থাকায় তাদের চাহিদা অত বাড়েনি।
চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই খোলাবাজারে এলএনজির দাম গত বছর রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। ২০২২ সালের ২৫ আগস্ট বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠে। সেদিন প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ৬৯ ডলার ৯৬ সেন্টে উঠে যায়। এখন আবার প্রতি এমএমবিটিইউ ২২-২৩ ডলারে নেমে এসেছে।
দাম কমলেও এলএনজির দাম এখনো অনেক বেশি। ২০২১ সালের আগে এলএনজির দাম কখনোই প্রতি এমএমবিটিইউ ২০ দশমিক ৫০ ডলারের ওপরে ওঠেনি। মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ, ভারতসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর এলএনজি আমদানি কমেছে গত বছর।
বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ ২০১৮ সালে প্রথম এলএনজি আমদানি শুরু করে। তখন বৈশ্বিক খোলাবাজারে এর দাম ছিল প্রতি ইউনিট ৪ ডলার। করোনা সংক্রমণের সময় ২০২০ সালের শুরুর দিকে তা ২ ডলারে নেমে আসে। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় বিশ্বব্যাপী বিধিনিষেধ উঠে গেলে জ্বালানি তেলের মতো এলএনজির দামও বাড়তে শুরু করে। ২০২২ সালের ২৫ আগস্ট বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠে। সেদিন প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ৬৯ ডলার ৯৬ সেন্টে উঠে যায়। এখন তা নেমে এসেছে ২৫ ডলারের নিচে। সেই হিসাবে দাম কমেছে প্রায় ৬৪ শতাংশ।
বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় গত বছর জুলাই মাসে বাংলাদেশ সরকার খোলাবাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আনা বন্ধ করে দেয়। দেশেও গ্যাসের উৎপাদন কমে যায়। দেখা দেয় সরবরাহের সংকট। শিল্পমালিকেরা কারখানা চালু করতে বাড়তি দামে গ্যাস আমদানির দাবি জানান। শিল্পমালিকেরা বলছেন, দাম বাড়িয়ে গ্যাস না দিলে শিল্প খাত ধ্বংস হয়ে যাবে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে দেশে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সরকার। কিন্তু বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম তুলনামূলকভাবে এখনো অনেক বেশি। সে জন্য সরকার দাম বাড়িয়েও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ডলারে কিনতে হবে এলএনজি। অথচ ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় প্রতি মাসেই দেশের রিজার্ভ কমছে। এ পরিস্থিতিতে কতটা এলএনজি গ্যাস আমদানি করা সম্ভব, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে যে ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এ বছরও তা চলবে। ইউরোপে এখন মজুত ভালো হলেও তাদের চাহিদা খুব বেশি হয়তো কমবে না। চীনের চাহিদা বাড়বে। ফলে এশিয়ার দেশগুলোর কয়লানির্ভরতা বাড়বে।