চীনে তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়িতে ইউরোপের অতিরিক্ত শুল্কারোপ নিয়ে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, তা প্রশমনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। গত শনিবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে চীনের ফোনালাপের পর এ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
ফোনালাপে ঠিক হয়েছে, ইইউ ও চীনের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে আরও আলোচনা করবেন, যদিও তাদের মধ্যকার সব বিবাদ যে মিটে গেছে, তা নয়। বিবিসি জানিয়েছে, চীনে উৎপাদিত বৈদ্যুতিক গাড়িতে ইইউ ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত শুল্কারোপের যে হুমকি নিয়েছে, তারপর এটাই তাদের প্রথম আলাপ।
ইইউর অভিযোগ, চীন বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনে অন্যায়ভাবে ভর্তুকি দেয়। এর জবাবে চীন বলেছে, ইউরোপ বাণিজ্যের নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করে সুরক্ষাবাদী নীতি গ্রহণ করেছে।
ইইউর মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, ইউনিয়নের বাণিজ্য কমিশনার ভালদিস দমব্রোভস্কির সঙ্গে চীনের বাণিজ্যবিষয়ক কর্মকর্তা ওয়াং ওয়েনতাওয়ের খোলামেলা ও গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে। উভয় পক্ষই আলোচনা চালিয়ে যাবে বলে জানানো হয়েছে।
আলোচনার পরিবেশ তৈরি হলেও ইইউ এখনো নিজ অবস্থানে অটল। অর্থাৎ তারা মনে করছে, চীন সরকার এসব বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনে বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি দেয়। এই ভর্তুকি দেওয়ার বিষয়টি ক্ষতিকর আখ্যা দিয়ে ইইউ বলেছে, এ বিষয়ে যে আলোচনাই হোক না কেন, ভর্তুকির বিষয়টি আমলে নিতে হবে।
চীনে অবশ্য বারবার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। শনিবার তারা আবারও বলেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তাদের মতানৈক্য আছে।
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ফোনালাপের পাশাপাশি ওয়াং ওয়েনতাও জার্মানির ভাইস চ্যান্সেলর ও কেন্দ্রীয় অর্থ ও পরিবেশমন্ত্রী রবার্ট হেবেকের সঙ্গেও কথা বলেছেন। এ বৈঠক সম্পর্কে ফেসবুক পোস্টে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ইইউর সম্ভাব্য শুল্কারোপের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান কঠোর।
একই সঙ্গে চীন আবারও বলেছে, নিজেদের আইনি অধিকার রক্ষায় প্রয়োজন হলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় মামলা করা হবে।
এদিকে জার্মানির অবস্থান কিছুটা ভিন্ন। ইইউ প্রথম এই শুল্কারোপের হুমকি দিলে জার্মানির যোগাযোগমন্ত্রী ভোলকার ভিসিং বলেছিলেন, ইইউ এ ব্যবস্থা নিলে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঝুঁকি আছে।
এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ভোলকার আরও বলেন, ইইউ এ শুল্কারোপ করলে জার্মানির গাড়ি কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কেননা জার্মানির অনেক কোম্পানি চীনে গাড়ি উৎপাদন করছে।
ইউরোপীয় গাড়িশিল্পও ইউনিয়নের এই শুল্কারোপের মনোভাব প্রসঙ্গে নেতিবাচক। তারা বলছে, এই শুল্কারোপ করা হলে বিশ্ববাণিজ্যে ভাঙন ধরবে।
বর্তমানে চীনে উৎপাদিত বৈদ্যুতিক গাড়িতে ১০ শতাংশ শুল্ক আছে। তার ওপর ইইউ ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কারোপের চিন্তা করছে। মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র চীনে উৎপাদিত বৈদ্যুতিক গাড়িতে শুল্ক ২৫ থেকে ১০০ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরপর ইইউ একই পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেয়। গত অক্টোবরে শুরু হওয়া ইউরোপীয় কমিশনের তদন্তে যারা সহযোগিতা করছে, তাদের জন্য শুল্কহার হবে ২১ শতাংশ। যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়নি, তাদের জন্য শুল্কহার ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ। এর সঙ্গে বিদ্যমান শুল্ক যোগ হলে দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশের বেশি।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিসের এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বৈদ্যুতিক গাড়িশিল্পে চীন সরকার প্রায় ২৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বাড়াতে ক্রেতাদের বড় ধরনের আর্থিক সহায়তাও দেয় চীন সরকার। ২০১৮ সালে গাড়িপ্রতি চীন সরকারের আর্থিক সহায়তা পরিমাণ ছিল প্রায় ১৪ হাজার ডলার; ২০২৩ সালে তা ৪ হাজার ৬০০ ডলারে নেমে আসে।
চীনের গাড়িশিল্প মনে করছে, ইইউ অতিরিক্ত শুল্কারোপ করলে তেমন ক্ষতি হবে না। এ রকম সিদ্ধান্ত যে আসতে পারে, সে বিষয়ে তাদের আগে থেকেই ধারণা ছিল। অর্থাৎ তাদের পূর্বপ্রস্তুতি আছে।