রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যেকোনো খারাপ খবরেই বিশ্ববাজারে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাস কারখানা আগুনের কারণে বন্ধ হয়েছে বা ফ্রান্সের তেলের ডিপোয় ধর্মঘট হয়েছে কিংবা রাশিয়া ইউরোপের কাছে রুবলে গ্যাসের দাম চেয়েছে, অথবা আকাশ একটু ভার হয়েছে—এমন যেকোনো খবরে তেলের দাম বেড়েছে।
তবে চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে। এক বছর আগে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মানদণ্ড হিসেবে পরিচিত ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ছিল ১২০ ডলার, এখন তা ৭৫ ডলারের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে।
ইউরোপের গ্যাসের দাম কমে এসেছে। গত আগস্ট মাসে যার দাম ছিল সর্বোচ্চ, সেখান থেকে তেলের দাম ৮৮ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছে দ্য ইকোনমিস্ট।
এমন নয় যে বিশ্ববাজারে এখন খারাপ অবস্থা নেই। তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক ও তার সহযোগী দেশগুলো দফায় দফায় তেল উৎপাদন কমিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে টানা সাত সপ্তাহ ধরে উৎপাদনে থাকা তেল ও গ্যাসক্ষেত্রের সংখ্যা কমেছে। দাম কম থাকায় উৎপাদনকারীরা আগ্রহ হারাচ্ছে। নরওয়ের বেশ কিছু গ্যাস উৎপাদনকেন্দ্র দীর্ঘদিন ধরে রক্ষণাবেক্ষণের মধ্যে আছে। তা সত্ত্বেও তেলের মূল্যবৃদ্ধির যেকোনো সম্ভাবনা দ্রুতই মিইয়ে যাচ্ছে। ঠিক কী কারণে এমন ঘটছে?
দ্য ইকোনমিস্টের সংবাদে বলা হয়েছে, প্রত্যাশামতো চাহিদা বৃদ্ধি না পাওয়া এর একটি কারণ হতে পারে। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা কমে অর্ধেক হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি ব্যাংক ধসে যাওয়ার খবরে বিশ্বজুড়ে মন্দার আশঙ্কা ঘনীভূত হয়েছে। মূল্যস্ফীতির জোয়াল এখনো ইউরোপের ঘাড়ে চোপে বসে আছে। মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে উভয় মহাদেশেই ধারাবাহিকভাবে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু তার প্রভাব এখনো পুরোপুরি অনুভূত হয়নি।
এ ছাড়া চীনে যে হারে কোভিড-উত্তর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে হয়নি। প্রবৃদ্ধির এই নিম্ন হারের কারণে জ্বালানির চাহিদা কমেছে।
তারপরও দ্য ইকোনমিস্ট মনে করছে, চাহিদার এই নিম্নগতির বিষয়টি গল্পের একটি দিকমাত্র। পুনরুদ্ধারের গতি প্রত্যাশামতো না হওয়ায় গত এপ্রিল মাসে চীনে দৈনিক ১ কোটি ১৬ লাখ ব্যারেল তেল ব্যবহৃত হয়েছে। অন্তত বিধিনিষেধের কালের চেয়ে চীনে মানুষ ও পণ্যের যাতায়াত বেড়েছে, সে কারণে আগের চেয়ে অনেক বেশি জ্বালানি ব্যবহৃত হচ্ছে সেখানে।
যুক্তরাষ্ট্রের গ্রীষ্মকাল শুরু হয়েছে। তেলের দামও এক বছর আগের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম, ফলে গ্রীষ্মকালীন ভ্রমণের উপযুক্ত শর্ত বিরাজমান। এশিয়া ও ইউরোপে উচ্চ তাপমাত্রা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশা করা হচ্ছে, ফলে সেখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের চাহিদা বাড়তি থাকবে।
এই বাস্তবতায় তেলের দাম কমতির দিকে কেন—এ প্রশ্নের জুতসই উত্তর সরবরাহের দিক থেকে পাওয়া যেতে পারে। গত দুই বছর তেলের উচ্চ দামের কারণে ওপেকের বাইরের দেশগুলো তেল উৎপাদনে উৎসাহ পেয়েছে, যে তেল এখন বাজারে আসতে শুরু করেছে। আটলান্টিকের অববাহিকা থেকে বাজারে তেল আসছে, ব্রাজিল ও গায়ানা প্রচলিত ধারার কূপ থেকে তেল উত্তোলন করছে; সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা ও কানাডায় শেল ও টার স্যান্ড থেকে তেল উৎপাদিত হচ্ছে। নরওয়েও বাজারে তেলের জোগান বাড়িয়েছে।
বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মর্গানের হিসাব, ২০২৩ সালে ওপেক–বহির্ভূত দেশগুলো থেকে দৈনিক তেল উৎপাদন ২২ লাখ ব্যারেল বাড়বে।
তাত্ত্বিকভাবে দেখলে ওপেক ও রাশিয়া যে হারে তেল উৎপাদন হ্রাসের ঘোষণা দিয়েছে এবং তার ওপর সৌদি আরব যে অতিরিক্ত হারে তেলের উৎপাদন কমানোর ঘোষণা দিয়েছে, তাতে বাজারে ভারসাম্য আসার কথা।
গত এপ্রিল মাসে ওপেকের সদস্যরা দিনে ১২ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন হ্রাসের ঘোষণা দেয়, রাশিয়া দেয় দিনে ৫ লাখ ব্যারেল হ্রাসের। ওপেকের ঘোষণার বাইরে সৌদি আরব নিজে থেকে দিনে ১০ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন হ্রাসের ঘোষণা দেয়। কিন্তু এসব দেশের উৎপাদন ঘোষণামতো কমেনি।
ভেনেজুয়েলায় শেভরন বিনিয়োগ করেছে; ইরান ২০১৮ সালে নতুন করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় খপ্পরে পড়ার পর এখন সর্বোচ্চ উৎপাদন করছে। বস্তুত, বিশ্বের পাঁচ ভাগের এক ভাগ তেল এখন আসছে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত দেশগুলো থেকে। তারা কম দামে তেল বিক্রি করে দাম কমিয়ে দিচ্ছে।
গ্যাসের ক্ষেত্রে আবার সরবরাহ পরিস্থিতি আরেকটু জটিল। রাশিয়া থেকে যে পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে গ্যাস যায়, তা বন্ধ। যুক্তরাষ্ট্র এলএনজি রপ্তানি করে তার যে ফ্রিপোর্ট এলএনজি রপ্তানির পাঁচ ভাগের এক ভাগের জোগান দেয়, গত বছর বিস্ফোরিত হওয়ার পর এ বছর তা আবার উৎপাদনে এসেছে। পাইপলাইন ছাড়া ইউরোপে রাশিয়ার রপ্তানি অব্যাহত আছে, ভিন্ন পথে। জুলাই মাসে নরওয়ের সরবরাহ পুরোদমে চালু হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ইউরোপের হাতে বিশাল মজুত আছে। তাদের মজুত এখন সক্ষমতার ৭৩ শতাংশ, এক বছর আগেই যা ছিল কেবল ৫৩ শতাংশ, ডিসেম্বর মাসে যা ৯০ শতাংশে উন্নীত হবে।
তবে সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটে। তেলের বাজারের বিশ্লেষক ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির পূর্বাভাস, বৈশ্বিক তেলের চাহিদা ২০২৩ সালেই দিনে ১০ কোটি ২৩ লাখ ব্যারেল ছাড়িয়ে যাবে।
তেলের সরবরাহও রেকর্ড উচ্চতায় উঠবে। কিন্তু পূর্বাভাস বলছে, এ বছরের দ্বিতীয় ভাগে বাজারে ঘাটতি তৈরি হবে। অনেক ব্যাংক তা মনে করছে। শীতকাল এলে এলএনজির কার্গো ভাড়া করা নিয়ে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও তীব্র হবে। মালবাহী জাহাজের ভাড়া ইতিমধ্যে বাড়তে শুরু করেছে।
এত কিছু সত্ত্বেও গত বছর বিশ্ববাজারে তেলের বাজারে যে দুঃস্বপ্নের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা কম।
অধিকাংশ বিশ্লেষকই মনে করছেন, ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলারের কাছাকাছি উঠে যাবে, তিন অঙ্কের ঘর ছোঁবে না। গ্যাসের দাম শরৎকালে এখনকার চেয়ে ৩০ শতাংশ বাড়তে পারে, তা–ও খুব একটা চরম মাত্রায় পৌঁছাবে না। গত এক বছরে পণ্যের বাজার খাপ খাইয়ে নিয়েছে। ফলে, এখন দুঃসংবাদের আভাস পাওয়ামাত্র তেলের দাম বাড়বে না।