১২০ বছরে কত ইতিহাসের সাক্ষী রয়েল এনফিল্ড

বিখ্যাত মোটরসাইকেল রয়েল এনফিল্ডকে অনেকেই মনে করেন ভারতের ব্রান্ড। এমনকি ভারতীয়রা একে তাঁদের নিজস্ব পণ্য মনে করেন। ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে এটি এমনভাবে জড়িয়ে গেছে, এটির ব্রান্ড মালিকানা যে ভারতের নয়, তা অনেকেই জানেন না। রয়েল এনফিল্ডের মূল শিকড় হচ্ছে যুক্তরাজ্যে। এ কোম্পানি জনপ্রিয়তা ও বিক্রি বাড়ে ভারতে আসার পর। ঐতিহ্যবাহী এই মোটরসাইকেল ব্রান্ডের বয়স ১২০ বছরেরও বেশি। বলা হয় রয়েল এনফিল্ড যাঁরা চালান, তাঁদের নাকি সমাজে আলাদা মর্যাদা তৈরি হয়।

১৮৯৮ প্রথম মোটরচালিত যান তৈরি করলেও রয়েল এনফিল্ডের মোটরসাইকেলের যাত্রা শুরু হয় ১৯০১ সালে। নতুন শতাব্দীতে এক নতুন চমক নিয়ে আসে রয়েল এনফিল্ড। উদ্যোক্তা বব ওয়াকার স্মিথ আরেক ফরাসি উদ্যোক্তা জুলেস গোটিয়েটকে নিয়ে প্রথম মোটরসাইকেলটি তৈরি করেন।

এনফিল্ড ১৯০১ সালে তাদের প্রথম ২৩৯ সিসি মোটরবাইক বাজারে আনে।

রয়েল এনফিল্ডের শুরু

১৮৯৬ সালে এডি মিডলসেক্সের এনফিল্ড শহরে রয়েল স্মল আর্মস ফ্যাক্টরির জন্য যন্ত্রপাতি তৈরির কন্ট্রাক্ট পায় এবং এখান থেকেই রয়েল এনফিল্ড নামের জন্ম। এ বছরই তারা নিউ এনফিল্ড সাইকেল কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি কিনে নেয় এবং এখান থেকে ১৮৯৭ সালে সাইকেলের সব ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরি শুরু করে। ধীরে ধীরে যখন মোটরচালিত সাইকেল ইংল্যান্ডে জনপ্রিয় হয়, তখন এনফিল্ড কোম্পানিও মোটরসাইকেল তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। দুই বছর চেষ্টার পর এনফিল্ড ১৯০১ সালে তাদের প্রথম ২৩৯ সিসি মোটরবাইক বাজারে আনে। এটি ছিল ১১ দশমিক ২ হর্সপাওয়ার (এইচপি) ক্ষমতাসম্পন্ন। তবে রয়েল এনফিল্ডকে সাফল্য এনে দিয়েছিল ১৯০৯ সালে তৈরি তাদের ভি টুইন ২৯৭ সিসি ইঞ্জিনের মোটরসাইকেল। এই মোটরসাইকেলের কাঠামো ছিল আলাদা, ইঞ্জিনও ছিল বেশ শক্তিশালী।

বুলেট ৩৫০ সিসি এবং ৫০০ সিসি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে খুব অল্প সময়েই।

বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী

এনফিল্ডের ২ স্ট্রোক মোটরসাইকেলের উৎপাদনও শুরু হলো, প্রথম বিশ্বযুদ্ধও শুরু হলো। যুদ্ধের সময় ব্যাপক চাহিদা তৈরি হওয়ায় কোম্পানিটি বেশ বড় আকারের মোটরসাইকেল বাজারে আনে। এটি ছিল ৭৭০ সিসির ও ৬ এইচপি ভি ভি-টুইন মোটরসাইকেল। যুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যসহ বেলজিয়াম, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে মোটরসাইকেল সরবরাহ করে রয়েল এনফিল্ড। বন্দুকের মতো তৈরি বাইকগুলো তাদের শক্ত কাঠামো এবং অনেক দূর যেতে পারার কারণে সেনাবাহিনীর কাছে খুব জনপ্রিয় ছিল।

১৯২৪ সালে নতুন ৮ মডেলের মোটরসাইকেল এনে তাক লাগিয়ে দেয় এনফিল্ড। এর মধ্যে একটি স্পোর্টস মডেলও ছিল। ১৯২৮ সালে রয়েল এনফিল্ড তাদের মোটরসাইকেলের চেহারা পরিবর্তন করে। ফ্ল্যাট ট্যাংকের পরিবর্তে বাইকগুলোয় স্যাডল ট্যাংক ব্যবহার করা হয়। সামনের ডিজাইনেও পরিবর্তন আনা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার রয়েল এনফিল্ডের সঙ্গে চুক্তি করে। এবার এই কোম্পানি মিলিটারি গ্রেড মোটরসাইকেল উৎপাদন শুরু করে। এ সময় তারা ২৫০ সিসি, ৩৫০ সিসি এবং ৫৭০ সিসি ইঞ্জিনের মোটরসাইকেল তৈরি করে। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল রয়েল এনফিল্ড ডব্লিউডি/আরই। এটি বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল প্লেন থেকে প্যারাস্যুটের মাধ্যমে নিচে ফেলার জন্য। যুদ্ধের সময় বোমারু বিমানের হাত থেকে বাঁচার জন্য ওয়েস্টউডে একটি ভূগর্ভস্থ কারখানা নির্মাণ করা হয়েছিল।

ভারতে এল রয়েল এনফিল্ড

যুদ্ধপরবর্তী সময়ে ১৯৪৬-৫৪ সালে রয়েল এনফিল্ড নতুন নতুন বাইকের নকশা বাজারে আনে। এ বিখ্যাত মডেল ‘বুলেট’ বাজারে ছাড়ে এনফিল্ড। বুলেট ৩৫০ সিসি এবং ৫০০ সিসি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে খুব অল্প সময়েই। এরপর আসে রয়েল এনফিল্ড সুপার মিটিয়র এবং সুপার মিটিয়র কন্সটেলেশন। এগুলো ছিল ৭০০ সিসির বাইক।

১৯৪৯ সালে ৩৫০ সিসির বুলেট প্রথম ভারতের বাজারে আসে। ভারত সরকার এমন এক মোটরসাইকেলের সন্ধানে ছিল, যেটি সীমান্তে টহল দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী ব্যবহার করতে পারে। রয়েল এনফিল্ডের বুলেট ৩৫০ ছিল একেবারে মনমতো। ভারতীয় সেনাবাহিনী এটি ৮০০ ইউনিটের অর্ডার দেয়। ১৯৫৫ সালে ব্রিটিশ কোম্পানি রয়েল এনফিল্ড মাদ্রাজ মোটরসের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে চেন্নাইতে একটি সংযোজন কারখানা করে। প্রথম দিকে শুধু মোটরবাইক অ্যাসেম্বলিং করা হতো ভারতে। তবে ১৯৬২ সালের পর থেকে ভারতেই তৈরি হয় রয়েল এনফিল্ড। আর এভাবেই বিকাশ লাভ করে রয়েল এনফিল্ড। বর্তমানে সারা বিশ্বে ৫০টির বেশি দেশে বাইক বিক্রি করছে এনফিল্ড।

ভারতের রাস্তায় সোনাক্ষী সিনহাকেও দেখা যায় রয়েল এনফিল্ডের মোটরসাইকেল চালাতে

সেলিব্রেটিদের মোটরসাইকেল রয়েল এনফিল্ড

মার্কিন অভিনেতা ব্রাড পিটের অস্কারজয়ী সিনেমা ‘দ্য কিউরিয়াস কেস অব বেনঞ্জামিন বাটন’ দেখে থাকবেন। সেখানে তরুণ ব্রাড পিট যে মোটরসাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন, সেটি ছিল রয়েল এনফিল্ড ব্রান্ডের মোটরসাইকেল। সিনেমায় ভারতের বারানসির রাস্তায় এই মোটরসাইকেলে চালিয়ে ঘুরেছেন ব্রাড পিট।

‘দ্য দার্জিলিং লিমিটেড’ সিনেমাটিতে অড্রিয়ান বড্রি, ওয়েন উইলসন ও জেসন শোয়ার্টজম্যানকে এক সঙ্গে একটি রয়েল এনফিল্ডের মোটরসাইকেলে করে ঘুরতে দেখা যায়। ক্রিকেটের ফিল্ডিংয়ের সুপারম্যান হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক খেলোয়াড় জন্টি রোডস। তাঁর শখের তালিকায় আছে মোটরসাইকেল চালানো। জন্টির সংগ্রহে আছে রয়েল এনফিল্ড ক্ল্যাসিক-৩৫০ নামের একটি অভিজাত মোটরসাইকেল। মূলত, ভারতে এসেই তাঁর এ আগ্রহ তৈরি হয়।

ভারতীয় সেলিব্রেটিদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় এই মোটরসাইকেল। অভিনেতা বরুণ ধাওয়ান, আদিত্য রায় কাপুর, শহীদ কাপুর, জন আব্রাহাম, জ্যাকি শ্রফও ব্যবহার করেন এই ব্রান্ডের মোটরসাইকেল। নারী সেলিব্রেটিদের মধ্যে গুল পানাং, কোয়েচি কালকিন, সোনাক্ষী সিনহাকেও দেখা যায় রয়েল এনফিল্ডের মোটরসাইকেল চালাতে।