শ্রীলঙ্কা সরকার অত্যাবশ্যকীয় নয়, এমন সব ব্যক্তিগত যানবাহনের কাছে জ্বালানি বিক্রি দুই সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেছে। কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়ার কারণে দেশটি এমন পদক্ষেপ নিয়েছে।
আগামী ১০ জুলাই পর্যন্ত ব্যক্তিগত যানবাহনের জন্য পেট্রল ও ডিজেল বিক্রি নিষিদ্ধ থাকবে। এ সময় দেশটিতে বাস, ট্রেন ও চিকিৎসা পরিষেবা এবং খাদ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত যানবাহনগুলোতেই কেবল জ্বালানি (ডিজেল ও পেট্রল) নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে।
সরকারি কর্মকর্তারা জানান, অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্রদানকারী যানবাহনগুলোর কাছে বিক্রি করার মতো মাত্র ৯ হাজার টন ডিজেল ও ৬ হাজার টন পেট্রল মজুত রয়েছে। এই মজুত দিয়ে এক সপ্তাহের চাহিদা মেটানো যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার শহরাঞ্চলের স্কুলগুলো ইতিমধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ২ কোটি ২০ লাখ মানুষকে হোম অফিসে যেতে, অর্থাৎ বাড়িতে থেকে কাজ করতে বলা হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি বর্তমানে জ্বালানি ও খাদ্যের মতো নিত্যপণ্যের আমদানি মূল্য পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রীলঙ্কা একটি আর্থিক পুনরুদ্ধার চুক্তি করার বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইনভেস্টেকের তেল ও গ্যাসসংক্রান্ত গবেষণার প্রধান নাথান পাইপার বলেন, ‘১৯৭০-এর দশকের তেলসংকটের পরে শ্রীলঙ্কাই হলো বিশ্বের প্রথম দেশ, যারা সাধারণ মানুষের কাছে জ্বালানি বিক্রি বন্ধ করার কঠোর পদক্ষেপ নিল। ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে রেশনিং ব্যবস্থায় জ্বালানি বিক্রি করা হয়েছিল। পাশাপাশি জ্বালানি চাহিদা কমাতে গাড়ির গতিসীমা চালু হয়েছিল।’ উল্লেখ্য, তখন গাড়ির গতিসীমা চালু করা হয়। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট গতির নিচে গাড়ি চলতে পারত না।
নাথার পাইপার আরও বলেন, তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সীমিত হয়ে পড়ার কারণেই শ্রীলঙ্কা পেট্রল বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কীভাবে জ্বালানি ছাড়া চলতে হবে, তা দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপদেশটির মানুষজন জানেন না। অবশ্য সাম্প্রতিক মাসগুলোতে শ্রীলঙ্কাজুড়েই ফিলিং স্টেশনগুলোয় তেলের জন্য গাড়িওয়ালাদের দীর্ঘ লাইন তথা সারি দেখা যাচ্ছে।
কলম্বোর ২৯ বছর বয়সী ট্যাক্সিচালক চিনথাকা কুমারা মনে করেন, পেট্রল বিক্রির ওপর শ্রীলঙ্কা সরকারের নতুন এই নিষেধাজ্ঞা ‘মানুষের জন্য আরও সমস্যা তৈরি করবে’। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘আমি একজন দৈনিক ভিত্তিতে মজুরি উপার্জনকারী। আমি তিন দিন ধরে পেট্রল পাওয়ার লাইনে রয়েছি। কখন পেট্রল পাব, তা জানি না।’
জ্বালানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠায় শ্রীলঙ্কা সরকার এখন পেট্রল রেশনিং করার পথে হাঁটছে। এ লক্ষ্যে গাড়িচালকদের হাতে টোকেন ধরিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে যেতে বলা হয়েছে। অনেক গাড়িচালক লাইনে ছিলেন, আবার অনেকে তা-ও করতে পারেননি।
বেসরকারি খাতের নির্বাহী এস উইজেতুঙ্গা বিবিসিকে বলেন, ‘আমি দুই দিন লাইনে ছিলাম। আমি একটি টোকেন পেয়েছি, নম্বর ১১। তবে কখন জ্বালানি পাব, তা আমি জানি না।’ তিনি বলেন, ‘আমাকে এখন অফিসে যেতে হবে, তাই আমার গাড়িটি এখানে রেখে থ্রি-হুইলারে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই।’
করোনা মহামারি, ক্রমাগতভাবে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং সরকার কর কমানোর জনপ্রিয় নীতির কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে বড় ধরনের অভিঘাত এসেছে। এ অবস্থায় দেশটিতে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার অভাব রয়েছে।
জ্বালানি, খাদ্য ও ওষুধের তীব্র ঘাটতি শ্রীলঙ্কার মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। দেশটির অনেক মানুষই জীবিকার জন্য মোটরগাড়ির ওপর নির্ভরশীল।
দেশটির মন্ত্রিপরিষদের মুখপাত্র বন্দুলা গুনাবর্ধনা বলেছেন, ‘শ্রীলঙ্কা তার ইতিহাসে আর কখনো এত বড় অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়নি।’
এদিকে নগদ অর্থের সংকটে থাকা দেশটি সস্তায় তেল সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য বিশ্বের অন্যতম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশ রাশিয়া ও কাতারে কর্মকর্তাদের পাঠিয়েছে।
দেশটির বিদ্যুৎ ও জ্বালানিমন্ত্রী কাঞ্চনা উইজেসেকেরা রোববার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা নতুন মজুত পাওয়ার জন্য যা যা করা যায়, তার সবই করছি। কিন্তু আমরা জানি না কখন তা হবে।'
অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের একজন জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ অ্যালেক্স হোমস বলেছেন, জ্বালানি বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হচ্ছে শ্রীলঙ্কায় ‘ক্রমবর্ধমান সংকটের আরেকটি ছোট লক্ষণ’।