সেই তো নথ খসালি, তবে কেন লোক হাসালি, রেট্রোসপেকটিভ ট্যাক্স বা ভূতাপক্ষো কর নিয়ে ভারতে যা হলো, তা অনেকটা এই প্রবাদের মতো।
বিষয়টি হলো, এই আইনের কারণে ভারত আন্তর্জাতিক পরিসরে বেকায়দায় পড়েছিল। কেয়ার্নের মতো কোম্পানি ভারত সরকারের বিরুদ্ধে মামলা জিতে ফ্রান্সে ভারতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার রায় পেয়েছিল। সেখান থেকে অনেকটা নাক বাঁচাতে কর আইনের এই সংশোধনী শেষমেশ বাতিল করল লোকসভা। তবে রাজ্যসভার আনুষ্ঠানিকতা এখনো বাকি।
এই সংশোধনী বাতিলের মধ্য দিয়ে ভারত বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের বার্তা দিল, ভারত ভুল সংশোধন করতে ইচ্ছুক। এ ছাড়া করারোপের ব্যাপারে ভারতের অবস্থানও স্পষ্ট হলো এতে।
ভারতে ব্যবসা করছে এমন বিদেশি কোম্পানি ভারতের সম্পত্তি হস্তান্তর করার জন্য যদি শেয়ার হস্তান্তর করে মুনাফা করে, তবে তার ওপর কর বসাতে চেয়েছিলেন ইউপিএ সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। এমনকি বিদেশের মাটিতে লেনদেন হলেও। সে জন্য ২০১২ সালের ২৮ মে আসে সংশোধিত আয়কর আইন। সেখানে এটাও বলা হয়, ওই আইন বলবৎ হওয়ার আগে যদি কোনো কোম্পানি ভারতে ওই ভাবে লাভ করে থাকে, তাতেও মেটাতে হবে কর। যে দিন ওই লেনদেন হয়েছে, সেই দিন থেকে। যা পুরনো লেনদেনে বকেয়া কর গণ্য হবে। বৃহস্পতিবার ওই বকেয়া কর আদায়ের নিয়ম বাতিল করতেই বিল আনল মোদি সরকার। নির্মলার দাবি, ভারত বিনিয়োগের আকর্ষণীয় গন্তব্য। কিন্তু পথের কাঁটা এই নিয়ম। তাই তা তোলার উদ্যোগ। লক্ষ্য, করোনার প্রভাব কাটিয়ে দ্রুত অর্থনীতি ঘুরিয়ে দাঁড় করানো।
তবে খোদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, সোনিয়া গান্ধী, পি চিদম্বরম এর বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁদের মত ছিল, এতে বিদেশি বিনিয়োগ মার খাবে। সংশোধনী বাতিলের পর চিদাম্বরম বলেন, 'ভোডাফোনে রেট্রসপেক্টিভ ট্যাক্স প্রত্যাহার করায় আমি খুশি, কারণ গত আট বছরে আমরা যে সমস্যার ভুগছিলাম, তাতে এ বার ইতি টানা গেল।' কিন্তু এর আবার বিরোধী মতও আছে। স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের যুগ্ম-আহ্বায়ক অশ্বিনী মহাজন বলেন, ''এটি প্রণব মুখার্জির দেশহিতে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ ছিল। সমস্যা হলো, সে সময় তাঁর দলের লোকেরাই এর বিরুদ্ধে ছিলেন। সংবাদমাধ্যম এমন আবহ তৈরি করেছিল, যেন তিনি একটা অপরাধ করে ফেলেছেন। যারা করফাঁকির স্বর্গরাজ্যে বসে কর চুরি করে, তিনি যদি সেই চোরেদের থেকে কর আদায়ের চেষ্টা করেন, তাতে ভুল কোথায়?'
লোকসভায় হট্টগোলের মধ্যে আলোচনা ছাড়াই অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সেই কর আইনে সংশোধন বিল পাশ করিয়ে নিয়েছেন। মনমোহন সরকারের সিদ্ধান্ত মোদি সরকার প্রত্যাহার করলেও কংগ্রেস বিরোধিতা করেনি। বরং সাবেক অর্থমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা পি চিদাম্বরম বলেছেন, তিনি এই সিদ্ধান্তে খুশি। অন্যদিকে মোদি সরকারের এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে প্রয়াত প্রণব মুখার্জির সিদ্ধান্তের পক্ষে দাঁড়িয়েছে আরএসএসের অর্থনৈতিক 'থিঙ্ক ট্যাঙ্ক' স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ। আরএসএস নেতাদের মতে, প্রণবের ওই সিদ্ধান্ত ছিল দেশহিতে তাঁর সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ।
২০১৪ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর অর্থমন্ত্রী হয়ে অরুণ জেটলি ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরা রেট্রসপেক্টিভ ট্যাক্সের পক্ষে নন। তবে জেটলি কর আইনে পরিবর্তন আনেননি। আবার আইন বহাল রেখেও ভোডাফোন, কেয়ার্ন এনার্জির থেকে কর আদায় করা যায়নি। এ বার ভোডাফোন, কেয়ার্ন এনার্জির সঙ্গে কর আদায় নিয়ে মামলায় হেরে গিয়ে মোদি সরকার রণে ভঙ্গ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্বদেশি জাগরণের নেতা অশ্বিনীর বক্তব্য, 'এটা সত্যি যে আন্তর্জাতিক সালিশির চাপে সরকারের সামনে আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু আসল কথা হলো, এতে চোরেদের হাজার হাজার কোটি টাকার সুরাহা দেওয়া হলো। সরকার ও মানুষের লোকসান হলো। বিদেশি বিনিয়োগের সমস্যার এটা একটা বড় উদাহরণ।'
কর বিবাদ ঘিরেই ভারত সরকারের সঙ্গে মনোমালিন্য তৈরি হয় ভোডাফোন গোষ্ঠীর। ভারতে টেলিকম শিল্পে বিনিয়োগের অনিচ্ছা প্রকাশ করেও পরবর্তীকালে আইডিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল তারা। কিন্তু সেই ভোডাফোন আইডিয়া এখন ধুঁকছে। কেন্দ্রীয় সাহায্য না পেলে কোম্পানি উঠে যাবে, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে সম্প্রতি হাতে ২৭ শতাংশ শেয়ার নিয়েও পর্ষদ ছেড়েছেন কোম্পানির কর্ণধার কুমার মঙ্গলম বিড়লা। সব মিলিয়ে বিনিয়োগ নিয়ে মোদি সরকারের মাথায় ব্যাপক চাপ। অনেকের ধারণা, রেট্রসপেক্টিভ ট্যাক্স উঠলে ভোডাফোন আইডিয়ার জন্য বিনিয়োগ আকর্ষণ আগের চেয়ে সহজ হতে পারে।
বিশ্লেষকেরা অবশ্য বলেন, মূলত আমলাতন্ত্রের শক্তিশালী একটি গোষ্ঠীর চাপেই মোদি সরকার রেট্রোসপেকটিভ করের বিরোধী হয়েও এত দিন তা জিইয়ে রেখেছিল। আমলাদের দাপটের কারণে ভারতের টেলিযোগাযোগ খাতও সেই অর্থে বিনিয়োগবান্ধব নয়। দুর্ণীতি দমন ও দ্রুততর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা বিজেপির জন্য এসব বিনিয়োগ প্রতিবন্ধকতা দূর করা চ্যালেঞ্জই বটে।
তবে এই নিয়ম বাতিল হওয়ায় ভারতে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষেকরো।