বৃহত্তম বাণিজ্য চুক্তি

নেতৃত্বের আসনে এখন চীন

  • ডোনাল্ড ট্রাম্প টিপিপি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নেওয়ার কারণে যে শূন্যস্থান তৈরি হয়, চীন দ্রুতই সেই জায়গা নিয়ে নিল।

  • ২০ বছরে আমদানিতে শুল্ক উঠিয়ে দেওয়া আরসিইপির লক্ষ্য।

  • বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ, টেলিযোগাযোগ, আর্থিক সেবা, ই-কমার্স এর আওতাভুক্ত হবে।

দীর্ঘ আট বছরের চেষ্টায় ফল পেল চীন। গতকাল রোববার সকালে আসিয়ানসহ জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে যে বাণিজ্য চুক্তি তারা করল, তাতে এটাই বোঝা গেল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের আধিপত্য কতটা। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই চুক্তি বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার ভারসাম্য বদলে দিতে পারে।

রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) বা ‘আঞ্চলিক সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারি’ শীর্ষক এই বাণিজ্য চুক্তির ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক পরিসর চমকে দেওয়ার মতোই—বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা ও ২৯ শতাংশ জিডিপি। চুক্তির আওতা খুব বড় না হলেও গুরুত্বের দিক থেকে এটি অনেক বড়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো-কানাডা চুক্তি বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়েও এটি বড়। ফলে এটি হবে বিশ্বের বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল। বিবিসি সূত্রে এই সংবাদ পাওয়া গেছে।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তির বিকল্প হিসেবে চীন এই চুক্তির নেতৃত্ব দিয়েছে, যদিও ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৭ সালে এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়।

অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশন্স বা আসিয়ানের ১০টি দেশ ও চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড এই চুক্তিতে সই করছে। প্রাথমিকভাবে ভারতও এই চুক্তির আলোচনা প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল। কিন্তু চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হলে শুল্ক কমাতে হবে এবং তাতে স্থানীয় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে—এই আশঙ্কায় ভারত গত বছর এই চুক্তির আলোচনা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তির বিকল্প হিসেবে চীন এই চুক্তির নেতৃত্ব দিয়েছে, যদিও ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৭ সালে এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমাতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা টিপিপি করেছিলেন। চীন ওই চুক্তিতে না থাকলেও অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো দেশ ছিল। টিপিপিতে বলা হয়েছিল, শিল্প খাতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা হ্রাস করতে হবে। মূলত চীনকে লক্ষ্য করেই এই ধারা রাখা হয়েছিল সেখানে, কারণ চীনা সরকার শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা বলে অন্যরা চীনা কোম্পানির সঙ্গে পেরে ওঠে না, এমন অভিযোগ আছে।

চীন ও জাপানের বিবাদ দীর্ঘদিনের—ঐতিহাসিক। অন্যদিকে সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও বিবাদে জড়িয়েছে চীন। এমনকি ভারত ও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব খর্ব করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত অনানুষ্ঠানিক কৌশলগত ফোরাম গঠন করেছে।

কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প টিপিপি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নেওয়ার কারণে যে শূন্যস্থান তৈরি হয়, চীন দ্রুতই সেই জায়গা নিয়ে নিল। তবে এর মধ্যেও তাকে ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সামাল দিতে হবে। আমদানি বাড়লে ভারত শুল্কহার বাড়াতে চেয়েছিল। এ ছাড়া শ্রমঘন ও উচ্চ প্রযুক্তির নয়—এমন শিল্পপণ্যের শুল্ক ছাড় চেয়েছিল। কিন্তু বেইজিং এখনই শ্রমঘন শিল্প তাদের দেশ থেকে সরাতে চায় না। আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় ভারত শেষমেশ আর এই চুক্তিতে যোগ দেয়নি। তবে তারা দরজা একেবারে বন্ধ করে রাখেনি, সময়-সুযোগমতো তারা এই চুক্তিতে যোগ দেবে, এমন সম্ভাবনা আছে।
তবে চীনের পথ একেবারে কণ্টকমুক্ত নয়। বিশ্বের এই বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলের রাজনৈতিক রসায়নটা খুব ভালো নয়।

চীন ও জাপানের বিবাদ দীর্ঘদিনের—ঐতিহাসিক। অন্যদিকে সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও বিবাদে জড়িয়েছে চীন। এমনকি ভারত ও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব খর্ব করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত অনানুষ্ঠানিক কৌশলগত ফোরাম গঠন করেছে। ফলে আরসিইপির এই গঠনবৈচিত্র্য বিশ্লেষকদের মনে যথেষ্ট কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে।

অন্যদিকে মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয় এবং জো বাইডেনের বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে নীতি ও কৌশলগত কী পরিবর্তন আসে, তার দিকেও তাকিয়ে থাকবেন বিশ্লেষকেরা। বাইডেন টিপিপির ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেননি। ফলে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে হারানো আসন ফিরে পেতে নতুন মার্কিন সরকার কী করে, সে দিকে সবার আগ্রহ থাকবে।

আগামী ২০ বছরে নিজেদের মধ্যকার আমদানিতে বিভিন্ন প্রকারের শুল্ক উঠিয়ে দেওয়া এই আরসিইপির লক্ষ্য। এ ছাড়া বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ, টেলিযোগাযোগ, আর্থিক সেবা, ই-কমার্স ও অন্যান্য পেশাদারি সেবাও এর আওতাভুক্ত হবে।

কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার রুলস অব অরিজিন বিধি এই চুক্তিতে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর অনেকেই ইতিমধ্যে নিজেদের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করে রেখেছে। কিন্তু এর আবার নানা সীমাবদ্ধতা আছে। আরসিইপির সাপেক্ষে বিদ্যমান এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিগুলো ব্যবহার করা জটিল হয়ে উঠতে পারে। যেমন ইন্দোনেশিয়ায় তৈরি কোনো পণ্যে অস্ট্রেলীয় যন্ত্রাংশ থাকলে আসিয়ান মুক্ত বাণিজ্য এলাকায় তা শুল্কের মুখে পড়তে পারে।

চুক্তিটি আগামী বছর কার্যকর হবে।