বৈদেশিক মুদ্রার সংকট

দুবাইভ্রমণে অস্থির দিরহাম, হজের কারণে রিয়াল

টাকার বিপরীতে ডলারের পাশাপাশি অন্যান্য মুদ্রার দামও বেড়েছে। ফলে বিদেশভ্রমণ, চিকিৎসা, কেনাকাটা ও হজযাত্রীদের খরচ বেড়ে গেছে।

আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছে, কেউ দুবাইয়ের শপিং মলে কেনাকাটা করছেন, সর্বোচ্চ ভবন বুর্জ খলিফায় ওঠার ছবি দিচ্ছেন। আবার কেউ দুবাইয়ের শেখের পোশাকে মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আবার অনেকেই দুবাইয়ে গেলেও কোনো ছবি প্রকাশ করছেন না। বাংলাদেশের একশ্রেণির নাগরিক যখন–তখন দুবাইয়ে চলে যান। যে কারণে দেশে দুবাইয়ের মুদ্রা দিরহামের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন প্রতি দিরহামের দাম ২৭ টাকার ওপরে, যা এক মাস আগেও ছিল ২৪ টাকা।

৫ জুন থেকে শুরু হবে হজ যাত্রা। এতে বেড়ে গেছে সৌদি মুদ্রা রিয়ালের দাম। ফলে এখন প্রতি রিয়াল কিনতে হচ্ছে ২৬ টাকায়। এভাবে দেশের মুদ্রাবাজারে মার্কিন ডলারের পাশাপাশি অন্যান্য মুদ্রার দামও অস্থির হয়ে পড়েছে। শুধু খোলাবাজারেই নয়, ব্যাংকগুলোতেও নগদ বিক্রিতে এসব মুদ্রার দাম বেড়ে গেছে। এর ফলে বিদেশভ্রমণ, চিকিৎসা, কেনাকাটা ও হজযাত্রীদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

ঢাকার মতিঝিলের মানি চেঞ্জারগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ইউরো বিক্রি হচ্ছে ১০৪ টাকায়, যা আগে ছিল ১০২ টাকা। পাউন্ড বিক্রি হচ্ছে ১২৪ টাকায়। এ ছাড়া গতকাল মঙ্গলবার ডলার বিক্রি হয়েছে ৯৮ টাকায়।

মতিঝিলের খোলাবাজারের ব্যবসায়ী মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের দাম বাড়ায় অন্য মুদ্রাগুলোর ওপর চাপ বেড়ে গেছে। অনেকে যে দেশে যাচ্ছেন, সেই দেশের মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বাজারে সেভাবে বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ নেই। এ জন্য দাম ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।

ব্যাংকগুলোতে বেশ কিছুদিন ধরেই নগদ বিক্রিতে বিদেশি মুদ্রার দাম বাড়তির দিকে। গতকাল রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক প্রতি ডলার ৯৩ টাকা ৫০ পয়সা, পাউন্ড ১২৩ টাকা ৫০ পয়সা, ইউরো ১০৩ টাকা ৫০ পয়সা, সিঙ্গাপুরের ডলার ৬৯ টাকা, ভারতীয় রুপি ১ টাকা ২৬ পয়সা, সৌদি রিয়াল ২৫ টাকা ২০ পয়সা, দুবাইয়ের দিরহাম ২৬ টাকা ২০ পয়সা দরে বিক্রি করেছে। তবে এসব মুদ্রার সরবরাহ তেমন নেই, এ জন্য সেভাবে বিক্রিও করতে পারেনি ব্যাংকটি।

বেসরকারি খাতের ইস্টার্ণ ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল) নগদে প্রতি ডলার ৯৭ টাকা, ইউরো ১০৪ টাকা ৩৮ পয়সা ও পাউন্ড ১২২ টাকা ৭৯ পয়সায় বিক্রি করেছে।

জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিউল আলম খান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। এই সুযোগে কেউ কেউ অন্যান্য মুদ্রারও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছেন। বিষয়টা সরকারি সংস্থাগুলো খতিয়ে দেখতে পারে। এতে দাম কমবে। মানুষের ওপরও চাপ কমে আসবে।

এদিকে মানি চেঞ্জাররা বলছেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার–সংকট কাটাতে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু খোলাবাজারের দিকে কারও কোনো মনোযোগ নেই। সংকট কাটাতে নগদ বিদেশি মুদ্রা আমদানির বিকল্প নেই।

ডলার বিক্রি অব্যাহত

ব্যাংক খাতে ডলারের সংকট কাটাতে ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা গতকাল সোনালী, অগ্রণী, কৃষিসহ সরকারি-বেসরকারি ৬ ব্যাংকের কাছে ১২ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি ২০২১–২২ অর্থবছরে ৫৭৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করল। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন তেল, গ্যাস, সারসহ সরকারি আমদানির পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে খাদ্য আমদানিতেও ডলার সরবরাহ করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গতকাল প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা। তবে ব্যাংকগুলো ৯৫ টাকা দরে প্রবাসী আয় আনছে ও রপ্তানি বিল নগদায়ন করছে। এর চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। ফলে আমদানি পণ্যের দাম ইতিমধ্যে বেড়ে গেছে। এতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর চাপে বাড়ছে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ করেছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক গাড়িসহ কিছু বিলাসপণ্য আমদানিতে ৭০ শতাংশ নগদ জমার বাধ্যবাধকতা দিয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ১৩৫টি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করেছে।

সংকট কাটাতে কাল সভা

এদিকে ডলার–সংকট কাটাতে করণীয় নিয়ে আগামীকাল বৃহস্পতিবার ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) সঙ্গে সভায় বসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে রপ্তানি বিল নগদায়ন ও প্রবাসী আয় আনার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে ডলারের দামের সীমা বেঁধে দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, ডলারের জোগান না বাড়লে দাম এভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। কারণ, আমদানি দায় পরিশোধের জন্য কোনো ব্যাংক ব্যর্থ হতে চাইবে না। এতে আন্তর্জাতিক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। এ জন্য ডলারের দাম বাড়লে ব্যাংকের কোনো ক্ষতি নেই।