জ্বালানি তেলের দাম তরতর করে বাড়ছে। প্রতি ব্যারেল ৮০ ডলারে উঠে গেছে, সঙ্গে শ্রমিকসংকটও আছে। তার সঙ্গে যোগাযোগের সংকট তো রয়েছেই।
সবকিছু বেশ ভালোই চলছিল। উন্নত দেশগুলো টিকাদানে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল। মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছিল। তার ওপর ভর করে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বলেছিল, চলতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রবৃদ্ধির হার ভালোই হবে।
এরপর বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে সরবরাহসংকট শুরু হয়। প্রথমে ধারণা ছিল, এতে হয়তো বিলাসবহুল গাড়ির সংকট হবে বা বড়জোর বড়দিনের সময় ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর উপকরণে টান পড়বে। কিন্তু বছরের শেষ প্রান্তে এসে সেই সংকট এখন পূর্ণাঙ্গ সরবরাহসংকটে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম তরতর করে বাড়ছে। এরই মধ্যে প্রতি ব্যারেলের দাম ৮০ ডলারে উঠে গেছে, সঙ্গে শ্রমিকসংকটও আছে।
এদিকে কোভিডের তৃতীয় ঢেউয়ের পর সারা বিশ্বেই এখন চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। চাহিদা বাড়ার কারণে সংকটও আর ঘনীভূত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে পরিবহনসংকটের কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে।
বহুজাতিক বিমা কোম্পানি আলিয়ানজের উপদেষ্টা মোহাম্মদ আল-আরিয়ান ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন, এ সপ্তাহে চীনের উৎপাদনশীল কারখানার উৎপাদন কমে গেছে। এতেই পরিষ্কার হয়ে যায়, মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে আবার ধস নামতে পারে। তিনি আরও বলেন, নীতি প্রণেতারা যা ভেবেছিলেন, সরবরাহসংকট তার চেয়ে আরও গভীর হবে। তিনটি কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যুগপৎ মন্দা ও মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হবে, সেগুলো হলো সরবরাহ সংকট, যোগাযোগ ও শ্রমিকসংকট।
তিন সংকটের মধ্যে সবচেয়ে মূর্ত রূপ ধারণ করেছে জ্বালানিসংকট। যুক্তরাজ্যের পেট্রলপাম্পগুলো একের পর এক পেট্রলশূন্য হয়ে যাচ্ছে। চীন কয়লা থেকে বেরিয়ে এসে তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে যাচ্ছে। তাতে এমন পরিস্থিতি হয়েছে যে উত্তর চীনের কিছু অংশে দিনের বড় একটি সময় বিদ্যুৎ থাকে না। কারখানাগুলো উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। অথচ সামনেই বড়দিন। এখন ভরা উৎপাদনের মৌসুম। স্বাভাবিকভাবেই এবার ইউরোপ-আমেরিকা বড়দিনের সময় পণ্য সংকটে পড়বে।
অন্যদিকে কোভিডজনিত বিধিনিষেধের কারণে ভিয়েতনামের মতো উৎপাদনশীল দেশের পক্ষে কম্পিউটার চিপ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণে গাড়িসহ বৈদ্যুতিক যন্ত্রের উৎপাদন কমে গেছে।
আগস্টে ব্রিটেনের গাড়ি উৎপাদন গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৭ শতাংশ কমে গেছে। ফলে তারা অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো দেশে গাড়ি রপ্তানি কমিয়ে দিয়েছে। চিপ-সংকটের কারণে ভক্সওয়াগন, ফোর্ড ও ওপেল জার্মানির কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। ওপেল একটি কারখানা ২০২২ সাল পর্যন্ত বন্ধ করে দিচ্ছে।
এদিকে জাপানের পণ্য ভান্ডার আবার অনেকটাই কমে গেছে। এমনকি তা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে ২০১১ সালের ভূমিকম্প ও সুনামির পর যা আর দেখা যায়নি।
সংকটের সবচেয়ে খারাপ দিকটা হলো, জ্বালানি ও কাঁচামাল পাওয়া গেলেও উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়। পণ্য জাহাজিকরণের ভাড়া শিগগির কমবে না। ড্রিউরি শিপিং ইনডেক্সের তথ্যানুসারে, গত বছরের এ সময়ের তুলনায় এখন জাহাজ ভাড়া প্রায় ২৯১ শতাংশ বেশি। আবার কিছু পথে ভাড়া এখন ছয় গুণ—চীন থেকে ইউরোপের রটারডাম। আবার বেশি ভাড়া দিয়ে পণ্য আমদানি করেও ফায়দা নেই। ইউরোপের বিভিন্ন বন্দরে এখন শ্রমিকসংকট সৃষ্টি হয়েছে। চলাচলের শর্ত ও কোভিডজনিত বিধিনিষেধের কারণে ইউরোপে ট্রাকচালকেরও সংকট দেখা দিয়েছে। তৃতীয় ঢেউয়ের পর পুঞ্জীভূত চাহিদার কারণে সরবরাহব্যবস্থা চাপের মুখে পড়েছে।
ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সরবরাহব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ ফ্লাভিও রোমেরো ম্যাকাউ দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, সারা পৃথিবীতেই মানুষ প্রণোদনার টাকা পেয়েছে। সর্বশেষ করোনার বিধিনিষেধের কারণে মানুষের জমে থাকা অনেক চাহিদাও পূরণ করতে শুরু করেছে। ফলে তারা এখন পণ্য কেনার জন্য মুখিয়ে আছে। প্লে স্টেশন, ল্যাপটপ, ফোন, শরীরচর্চার উপকরণ—কী না কিনতে চায় তারা।’
কিন্তু সমস্যা হলো, উচ্চ চাহিদা ও কম সরবরাহের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। ফলে একধরনের স্থবিরতা তৈরি হচ্ছে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা।