টেলিকম খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে একের পর পর নতুন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ভারত সরকার। কিছুদিন আগেই টেলিকম খাতে শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগ অনুমোদন করেছে মোদি সরকার। এবার তারা জানায়, আপাতত চার বছর টেলিকমগুলোকে তরঙ্গ ও লাইসেন্স ফি বাবদ সরকারের বকেয়া না মেটালেও চলবে। দেশটির কেন্দ্রীয় টেলিকম দপ্তরের হিসাবের ভিত্তিতে এই বকেয়ার অঙ্ক নির্ধারণ করা হয়েছে।
মূলত এই বোঝা মাথায় নিয়েই বেহাল ভোডাফোন আইডিয়া (ভিআই)।
মোদি সরকারের ঘোষণা, আগামী চার বছর তরঙ্গের দাম মেটানোর বাধ্যবাধকতা থেকে ছাড় দেওয়া হবে টেলিকমগুলোকে। এমনকি সুদের টাকাও চার বছর পর সরকারি শেয়ারে রূপান্তরিত করা হবে। এ তো গেল সামষ্টিক পর্যায়ের ব্যাপার, গ্রাহকদের জন্যও সুখবর দিয়েছে মোদি সরকার। তারা জানিয়েছে, প্রিপেইড থেকে পোস্টপেইডে যেতে বা উল্টোটার ক্ষেত্রে লাগবে না নতুন কেওয়াইসি। চালু হবে ডিজিটাল কেওয়াইসি পদ্ধতি।
ভারতকে ২০২৫ সালের মধ্যে পাঁচ লাখ কোটি ডলারের অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করতে মোদি সরকারের পরিকল্পনা অর্থনীতির শ্লথগতির জেরে প্রশ্নের মুখে পড়েছিল করোনা সংকটের আগেই। নতুন সংস্কার তো পরের কথা, টেলিকমের মতো খাতে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। ফলে ব্যবসাবান্ধব মোদি সরকার বড় ধরনের সমালোচনার মুখে পড়ে। সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, অবশেষে শিল্পের সমস্যা মিটিয়ে বার্তা দিতে উদ্যোগী মোদি সরকার। লক্ষ্য, আর্থিক সংকটে দীর্ণ টেলিকম খাতে অক্সিজেন জোগানো। লাইসেন্স মাশুলের বিপুল বকেয়ায় ন্যুব্জ এই শিল্পের অগ্রগতি বাধা পেলে প্রধানমন্ত্রীর ‘ডিজিটাল বিপ্লব’ থমকে যেতে পারে। পরিস্থিতি এতটাই সঙিন হয়ে পড়ে যে সহায়তা না পেলে ব্যবসা বন্ধ করতে হতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছিল ভোডাফোন আইডিয়া।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতে ফাইভ–জি পরিষেবার অবকাঠামো নির্মাণের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সে জন্য তরঙ্গ কিনতে এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়তে যে বিপুল বিনিয়োগ লাগবে, মোদি সরকার তা ভালোভাবেই জানে। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় ভোডাফোনের মতো কোম্পানির পক্ষে সেই পথে হাঁটা এই মুহূর্তে কঠিন হবে তা বুঝেই এ দিন বিদেশি বিনিয়োগ আসার পথ চওড়া করা হয়েছে। কোম্পানিগুলোর আরজিতে সাড়া দিয়ে বদলানো হয়েছে এজিআরের হিসাব। টেলিকম নয় এমন ব্যবসা থেকে আয় ভবিষ্যতে তার থেকে বাদ থাকবে। কোম্পানির তরঙ্গ হাতে রাখার সময়সীমাও বাড়ছে।
এদিকে মোদি সরকারের সিদ্ধান্তে খুশি রিলায়েন্স জিয়োর কর্ণধার মুকেশ আম্বানি, ভারতী এয়ারটেলের সুনীল মিত্তাল, আদিত্য বিড়লা গোষ্ঠীর কুমার মঙ্গলম বিড়লা ও ব্রিটেনের ভোডাফোন গোষ্ঠীর সিইও নিক রিড। এর হাত ধরে মোদির ডিজিটাল–লক্ষ্য পূরণের বার্তা দিয়েছেন তাঁরা। প্রাথমিকভাবে তাঁরা নতুন বিনিয়োগের ইঙ্গিতও দিয়েছেন। সবকিছু ঠিকঠাক চললে ভোডাফোন বন্ধ হওয়ার জল্পনায় ইতি পড়বে বলে মনে করছে টেলিশিল্পের একাংশ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ নিয়ে যথারীতি টুইট বার্তা দিয়েছেন। বলেছেন, এটি টেলিকম খাতের ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তন, এই সংস্কারে শিল্প ও গ্রাহক, উভয় পক্ষই লাভবান হবে। এতে প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি কাজের সুযোগ নিশ্চিত হবে। সুবিধা যে সরকারেরও হবে, সে কথা বলেছেন টেলিকমমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, গ্রাহকদের পছন্দের পরিষেবা পাওয়া ও নতুন কোম্পানি আসার পথ চওড়া করতে টেলিকম খাতে নয়টি কাঠামোগত সংস্কার হচ্ছে, যাতে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হয়।
বস্তুত, রিলায়েন্স জিয়ো বাজারে আসার পরে যেমন দ্রুত ফোর–জি পরিষেবার বিস্তার ঘটে, তেমনি শুরুতে তাদের কার্যত বিনা পয়সায় পরিষেবা দেওয়ার জেরে তীব্র মাশুল যুদ্ধ শুরু হয়। আগে থেকেই সরকারি মাশুল ও করের বোঝা মেটাতে গিয়ে কোম্পানিগুলো আর্থিক সংকটে বেহাল হয়েছিল। এরপর অ্যাডজাস্টেড গ্রস রেভিনিউ (এজিআর) খাতে কেন্দ্রকে বিপুল টাকা মেটানোর দায় চাপায় পরিস্থিতি ঘোরালো হয়। এমনকি ভোডাফোন আইডিয়া টিকে থাকবে কি না, তা নিয়ে তৈরি হয় সন্দেহ।
ভারতের টেলিশিল্পের একাংশ বলছে, এই পরিস্থিতি প্রতিযোগিতার শর্ত নিয়ন্ত্রণ করবে এবং তার দায় কেন্দ্রের ওপরেও বর্তাবে। এই সমস্যা থেকেই বেরোতে চাইল কেন্দ্র। টেলিশিল্পে পুঁজি ঢালার আগ্রহ ফেরাতে মরিয়া তারা।
তার ওপরে এখনই সমস্যা মেটাতে উদ্যোগী না হলে শুধু চালু প্রযুক্তিই নয়, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে ফাইভ–জি প্রযুক্তির কথা বলছে ভারত, তার বাস্তবায়ন হওয়া নিয়েও সংশয় দেখা দিতে পারে। ফাইভ–জি তরঙ্গের আসন্ন নিলাম নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হলে রাজস্ব আদায় আরও কমতে পারে। সেই ইঙ্গিত মিলিয়েই অশ্বিনী বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারি ও এমনকি জানুয়ারি মাসেও সেই নিলাম হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে কোম্পানিগুলোকে বাঁচাতে সংস্কারমুখী প্যাকেজ দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
অভিযোগ আছে, ভারতের টেলিযোগাযোগ খাত জন্মলগ্ন থেকেই সর্বতোভাবে জনস্বার্থবিরোধী ও বিনিয়োগ বৈরী। ভারতের আমলাতন্ত্র ও সরকারি মালিকানাধীন বিএসএনএল-এমটিএনএলের প্রকৌশলীরা স্বাধীন নিয়ন্ত্রক হিসেবে টেলিকম রেগুলেটরি অথোরিটি অব ইন্ডিয়ার (টিআরএআই) অস্তিত্ব মেনে নিতে পারেনি। ভারতের টেলিকম খাত সংশ্লিষ্টদের আরও অভিযোগ, সরকারি প্রকৌশলী ও আমলাতন্ত্র ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকমিউনিকেশন নামের এক প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেয়। ফলে এ ধরনের টেকনিক্যাল বিষয় কার্যত আমলতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, যা টেলিকম খাতের জন্য শেষমেশ শুভ হয়নি। এ ছাড়া রেট্রসপেকটিভ ট্যাক্স আইনের কারণেও ভোডাফোনের মতো কোম্পানি ভারতে ব্যবসা করতে বিপাকে পড়ে, যদিও আগস্ট মাসে তা বাতিল করা হয়েছে। এরপর শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হলো এবং তরঙ্গ ও লাইসেন্স মাশুল বাবদ বকেয়া পরিশোধ চার বছরের জন্য স্থগিত করা হলো। বিশ্লেষকেরা আশা করছেন, এতে দেশটিতে টেলিকম খাতে বিনিয়োগ বাড়বে।