জার্মানির অভিবাসন নিয়ে ভাবতে বসলে প্রথমেই মাথায় আসবে শরণার্থীদের কথা। জার্মান নিয়োগকর্তারা—যাঁরা শ্রমিক খুঁজছেন—এই অভিবাসীদের মধ্য থেকে শ্রমিক খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। ১৯৯০ সালের অক্টোবরে দুই জার্মানি একত্র হওয়ার পর কয়েক দশকে দেশটির প্রবৃদ্ধির হার বেশ ভালো অবস্থানে আছে।
বেকারত্বের হারও সর্বনিম্ন পর্যায়ে। তবে দেশটির দুই-তৃতীয়াংশ কোম্পানির অভিযোগ, দক্ষ কর্মীর অভাবে আছে তারা। আর তাই বহির্বিশ্বের দিকে নজর দিতে হচ্ছে জার্মানিকে। তবে শ্রমিকের ধরন ও সংখ্যায় এ অভাব কি পূরণ হবে?
একনজরে দেখা যাক জার্মানির শ্রমবাজারের অবস্থা। দেশটির নমনীয় মজুরি প্রবৃদ্ধির কারণে আপাতদৃষ্টিতে কোনো শ্রমঘাটতি দেখা যায় না। তবে বাদেন ভ্যাসেমবার্গ শিল্পাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, নিয়োগকর্তারা এ বিষয়ে একমত নন। এই অঞ্চলে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ১ শতাংশ।
ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, কর্মীর খোঁজে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেও কোনো লাভ হয় না। দক্ষ শ্রমিকের অভাবে বয়স্ক সেবা সেন্টার ও পর্যটন খাত আরও বেশি ভুগছে। বাদেন ভ্যাসেমবার্গের অর্থমন্ত্রী নিকোল হফমেইস্টার বলেন, শ্রমিকঘাটতির জন্য প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া জার্মানির বয়স্ক জনগোষ্ঠী বৃদ্ধির কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যা আরও বাড়ছে।
মূলত নার্স, সেবাকর্মী, নির্মাণশ্রমিক, ছুতার, ইলেকট্রিশিয়ান ও আইটি বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে জার্মানিতে। এই অভাব পূরণ করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে অন্যান্য দেশ থেকে জার্মানিতে কর্মী নেওয়ার কথা বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছে দেশটির সরকার। গত বছর দক্ষ কর্মীদের নিয়োগ দিতে একটি নতুন অভিবাসন আইন বাস্তবায়নের কথা ভাবতে শুরু করে তারা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাইরে থেকে আধা দক্ষ শ্রমিকদের অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশটির সংসদ সদস্যরা আলোচনা শুরু করেন। দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্কের পর জার্মানির জোট সরকার দক্ষ শ্রমিক–কর্মী অভিবাসন আইন বিষয়ে একমত হয়। আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মধ্যডানপন্থী ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট ইউনিয়ন (সিডিইউ), বাভারিয়া রাজ্যে দলটির সহযোগী ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়ন (সিএসইউ) এবং মধ্যবামপন্থী ক্রিশ্চিয়ান ও সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসপিডি) জোটবদ্ধ হয়ে চালাচ্ছে জার্মান সরকার।
যদি ‘দক্ষ শ্রমিক অভিবাসন আইন’ পাস হয়, তাহলে কারিগরি দক্ষতা থাকা অভিবাসীদের জার্মানিতে আসা অনেক সহজ হয়ে যাবে। এত দিন কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হতো। ইইউয়ের বাইরের কাউকে চাকরি দিতে হলে আগে সেই কাজে ইউরোপের কোনো যোগ্য নাগরিককে না পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হতো। কিন্তু নতুন প্রস্তাবে সেই বাধ্যবাধকতা আর রাখা হচ্ছে না। কর্মী জার্মান ভাষায় পারদর্শী ও জার্মানির মানে দক্ষ হলে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া যাবে। খসড়া প্রস্তাবে এই বিষয়কেই সবচেয়ে বড় করে দেখা হচ্ছে। নতুন আইনটি ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা।
তবে নতুন এই অভিবাসননীতি নিয়ে সব পক্ষের সমালোচনার মুখেই পড়েছে সরকার। শরণার্থীবিরোধী দলগুলো তো রয়েছেই, ম্যার্কেলকে লড়াই করতে হচ্ছে নিজের ঘরেও। সিডিইউয়ের অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল অংশের ভয়, এ আইনকে এরই মধ্যে জার্মানিতে অবস্থান করা শরণার্থীদের চাকরি দেওয়ার কাজে লাগানো হতে পারে। ফলে, অভিবাসন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা বিতর্ক এখনই থামবে না। শ্রমমন্ত্রী হুবারটাস হেইল এ আইনকে জার্মানির ইতিহাসের ‘মাইলস্টোন’ বলে উল্লেখ করলেও এতে নিয়োগকর্তার সমস্যা খুব সামান্যই কমবে বলে মনে করেন তিনি। তবে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্ন উঠছে, তা হলো কতটা সুফল আনতে পারবে এই আইন?
আসলে জার্মান শ্রমিকদের চেয়ে দক্ষ—এটা প্রমাণ করা একজন বিদেশি শ্রমিকের জন্য অসম্ভব কঠিন। জার্মানিতে দ্বৈত শিক্ষাপদ্ধতি চালু রয়েছে। ফলে, বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের অর্ধেকই প্রায় ৩৩০ ধরনের রেজিস্টার্ড চাকরির জন্য দক্ষ থাকে। পড়াশোনার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগে—এমন বিষয়েও প্রশিক্ষণ পায় তারা। এই দ্বৈত শিক্ষাপদ্ধতি জার্মানির শিকড়ে গেঁথে গেছে। ইউরোপের অন্য কোনো দেশের সঙ্গে এর তুলনা করা যায় না। এখন সিরিয়া থেকে যে শরণার্থী জার্মানিতে আসছে, তাকে কিন্তু নিজের খরচে কাজের প্রশিক্ষণ নিতে হচ্ছে। যার ফলে প্রথমেই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে সে।
নতুন আইন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এর মাধ্যমে ইউরোপের বাইরে থেকে বছরে মাত্র ২৫ হাজার শ্রমিক নেওয়া সম্ভব হবে জার্মানির জন্য। প্রকৌশল খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এটি এই খাতের খুব বেশি হলে এক–দশমাংশ পূরণ করা যাবে। চলতি বছরের শুরুতে ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এক গবেষণায় দেখা গেছে, জনসংখ্যাগত ঘাটতির কারণে শ্রমজনিত সমস্যায় ২০৬০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর কমপক্ষে ২ লাখ ৬০ হাজার নতুন অভিবাসী শ্রমিকের প্রয়োজন জার্মানির।
‘বার্টেলসম্যান ফাউন্ডেশন’–এর প্রকাশিত ওই গবেষণায় আরও বলা হয়, এ জন্য প্রতিবছর ইউরোপের বাইরে থেকে ১ লাখ ৪৬ হাজার অভিবাসীর নিতে হবে জার্মানিকে। জার্মানি যদি বাইরে লোক না নেয়, তাহলে দেশটির অভ্যন্তরীণ বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কেবল বাড়বে। ২০৬০ সাল নাগাদ কমপক্ষে ১ কোটি ৬০ লাখ কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমবে।
২০ বছর আগে দেশটির সিডিইউ পার্টির নেতারা বিদেশি শ্রমিক নেওয়ার বিপক্ষেই প্রচার চালান। ‘চিলড্রেন ইনস্টিড অব ইন্ডিয়ানস’—এই স্লোগান ছিল তাঁদের। দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্কের পর জার্মানির জোট সরকার গত বছর দক্ষ শ্রমিক–কর্মী অভিবাসন আইন বিষয়ে একমত হন। দেশটির মহাজোট সরকারের বড় শরিক আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সিডিইউ নেতারাই বলছেন, জার্মানি কোনো ‘মাইগ্রেশন দেশ’ নয়; যদিও দেশটির এক–চতুর্থাংশ জনগোষ্ঠী বাইরে থেকে এসেছে।
অবশ্য এসপিডির এমপি লারস ক্যাসেলুসি ‘দক্ষ শ্রমিক অভিবাসন আইনের’ সমর্থন দিয়ে বলেছেন, রাজনৈতিক আশ্রয় ও অভিবাসন সমস্যা নিয়ে আসছে। দক্ষ শ্রমিক অভিবাসন আইন পাস না হলে পরে এটির সংশোধন করা যেতে পারে। এক্সপার্ট কাউন্সিল অব জার্মান ফাউন্ডেশন অন ইন্টিগ্রেশন অ্যান্ড মাইগ্রেশনের প্রধান থমাস বাওয়ের প্রস্তাব করেছেন, সম্ভাব্য অভিবাসীদের জার্মান ভাষা জানা এবং আগের কাজের অভিজ্ঞতা কাজের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।