সাইয়ের গ্যাংনাম স্টাইলের কথা মনে আছে? এই এক মিউজিক ভিডিওর সুবাদে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের গ্যাংনাম এলাকার নাম মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে অবশ্য বছর সাতেক আগের কথা। নাচ-গান পেরিয়ে নতুন ঘরানা কে-পপে (কোরিয়ান পপ) গা ভাসিয়ে বিশ্ব ঝুঁকে পড়েছিল গ্যাংনামের কোরীয় প্রসাধনী বা কসমেটিকসের প্রতি। কিন্তু ধীরে ধীরে এখন সেই শিল্পেও দেখা দিয়েছে ভাটার টান।
গ্যাংনাম এলাকার ঝাঁ–চকচকে অংশের শান্ত রাস্তায় ঝলমলে সোনালি রঙের একটি ভবন আছে। স্বাভাবিকভাবেই পথচারীদের চোখ চলে যায় সেখানে। বিলাসবহুল স্কিনকেয়ার লাইন সুলভাসু ব্র্যান্ডের শোরুম এটি। অবশ্য প্রথম দেখায় একে মোটেও দোকান বলে মনে হবে না। বরং একে ‘জাদুঘর’ বললেও বাড়াবাড়ি হবে না। এখানে একটি ছোট্ট বাক্সে ভরা ফেসক্রিমের দাম ১৫০ ডলার। এখানে ফেসিয়ালও করা যায়। ওপরের তলায় ব্যয়বহুল ফেসিয়াল করাতে করাতে কফিতে চুমুক দেওয়া যে–কেউ সুলভাসুর সাজসজ্জা দেখে মুগ্ধ হতে বাধ্য।
সুলভাসুর কয়েক রাস্তা পরেই মি. জার্টের শোরুম। এই ব্র্যান্ডের মূল লক্ষ্য তরুণীরা। এটি লোশনের জন্য বিখ্যাত। তাদের উচ্চ প্রযুক্তির লোশনের মূল আকর্ষণ—‘এই গরমেও ঠান্ডা থাকুন’। ব্র্যান্ডটির দাবি, উজ্জ্বল রঙের মিল্কশেক কাপে বানানো তাদের ফেসমাস্ক তরুণীদের চেহারা সজীব রাখতে সাহায্য করে।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, সুলভাসু ও মি. জার্টের মতো শত শত ব্র্যান্ডে ভরে গেছে দক্ষিণ কোরিয়ার কসমেটিকস জগৎ। তারকাসমৃদ্ধ বিনোদনজগতের চেয়ে এর আবেদন কোনো অংশে কম নয়। কোরীয় প্রসাধনসামগ্রী বিশ্বজুড়ে শুধু নারীদেরই নয়, পুরুষদেরও আকৃষ্ট করেছে। একে সংক্ষেপে ‘কে-বিউটি’ নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এই শিল্পের উন্নতি চায় দক্ষিণ কোরিয়া। তাই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে তোলা হয়েছে আলাদা ইনস্টিটিউট। কোরিয়া কসমেটিক ইন্ডাস্ট্রি ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা সান সাং-মিনের দাবি, ইউরোপের ঐতিহ্যবাহী ব্র্যান্ডগুলোর চেয়ে কে-বিউটির গুণমান একেবারেই আলাদা।
কোরিয়ার সেলিব্রিটিদের মসৃণ, সুন্দর ত্বক এরই মধ্যে আমজনতার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁদের অনেকে যে প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছেন, এ কথা অবশ্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। অন্যদিকে, নতুন নতুন ট্রেন্ডের খোঁজে ইউটিউব ও ইনস্টাগ্রাম মাতিয়ে রাখা তারকাদের অনুসরণ করেন ইউরোপ-আমেরিকার তরুণীরা। তাদের দেখাদেখি কে-বিউটির ১০ ধাপের ক্লিনজিং প্রোগ্রাম, স্নেইল-স্লাইম ফেসিয়াল অথবা পান্ডা মাস্কের মতো সৌন্দর্যের নানা ধরনের উপকরণ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রসাধনপণ্য রপ্তানি ১৬০ কোটি ডলার থেকে প্রায় চার গুণ বেড়ে ৬৩০ কোটি ডলারে দাঁড়ায়।
তবে বাণিজ্যের ওই স্বর্ণযুগ এখন অতীত। বর্তমানে সুলভাসুর মতো কয়েকটি ব্র্যান্ডের মালিক আমোরপ্যাসিফিক গ্রুপও বাজারে টিকে থাকার জন্য লড়ছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় উৎপাদিত মোট প্রসাধনপণ্যের দুই-তৃতীয়াংশ দেশেই বিক্রি হয়। বাকি পণ্যের বেশির ভাগের ক্রেতা ছিল চীন। দুই বছর আগে দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র-প্রতিরক্ষাব্যবস্থা স্থাপনের পর থেকে সি চিন পিংয়ের দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছেদ করে। এরপর থেকে ক্রমেই দেশটির প্রসাধনশিল্প পিছিয়ে পড়ছে। লাভের পরিমাণ কমে গেছে অনেকটাই।
ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি আরও কিছু সমস্যা ভোগাচ্ছে কোরীয় প্রসাধনশিল্পকে। যেমন কিছুদিন আগে বাজারে পণ্য ছাড়তে দেরি হচ্ছিল আমোরপ্যাসিফিক গ্রুপের। দক্ষিণ কোরিয়ার কসমেটিকস বাজার এককালে স্রেফ দেশীয় পণ্যের ওপর নির্ভরশীল হলেও বিশ্বায়নের দুনিয়ায় অন্তর্জালের মাধ্যমে তা বিভিন্ন দেশের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। দক্ষিণ কোরিয়ার কসমেটিকস নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বিলাসবহুল পণ্য তৈরিতে বেশি মনোযোগী। ফলে, সমাজের একটি মাত্র স্তরের কথা ভাবতে গিয়ে দেশের বিপুলসংখ্যক গ্রাহক তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে।
এখন তাই নতুন কৌশল নিচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রসাধনশিল্প। যেমন আমোরপ্যাসিফিকের পদস্থ কর্মকর্তা টিমোথি পার্ক নিজেদের ভুলটা বুঝতে পেরে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এ-বিউটিকে পুঁজি করতে চাইছেন। ‘এ’ বলতে তারা এশিয়াকে বোঝাচ্ছেন। এরই মধ্যে এশিয়াকে পুঁজি করে সুলভাসুর ওয়েবসাইট ভরে গেছে নানা পণ্যের বিজ্ঞাপনে। এশিয়ার বাজার ধরতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছে কসমেটিকস নির্মাতা কোম্পানিগুলো। এক মহাদেশে আটকে না থেকে এবার ইউরোপ-আমেরিকাতেও ক্রেতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে তারা। প্যারিসের এক ডিপার্টমেন্ট স্টোরে নিজেদের আউটলেট বসিয়েছে। আমোরপ্যাসিফিক আগামী পাঁচ বছরে আরও ২০টি দেশে নিজেদের ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনা এরই মধ্যে চূড়ান্ত করেছে।
তবে এতেও প্রতিবন্ধকতা চোখ রাঙাচ্ছে। বিবিসি বলছে, ইউরোপ ও আমেরিকায় আধিপত্য বিস্তার করা দক্ষিণ কোরিয়ার প্রসাধনী কোম্পানিগুলোর জন্য বেশ কঠিন হবে। সাংশিন উইমেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিম জু-ডাকের মতে, ইউরোপীয়রা কে-বিউটি ট্রেন্ডের সঙ্গে পরিচিত হলেও ব্র্যান্ড হিসেবে একে এখনো গ্রহণ করতে পারেনি।
ওদিকে ঘরেও শান্তি নেই। স্বদেশেই নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রসাধনশিল্প। সাম্প্রতিক এক আন্দোলনের অংশ হিসেবে প্রসাধনসামগ্রী ছুড়ে ফেলছেন কোরীয় নারীরা। কসমেটিকসের বাক্স ভেঙে তার সামনে দাঁড়িয়ে তোলা ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টও করা হচ্ছে। চীনের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার চেয়ে বরং এই আন্দোলন কে-বিউটি শিল্পের জন্য বেশি ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এত কিছুর মধ্যে শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ার কসমেটিকস জগৎ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে কি না, তা–ই এখন দেখার।