ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লে প্রবৃদ্ধি বাড়বে না

অমর্ত্য সেন
 ফাইল ছবি

শুধু বাজার থাকলেই হবে না, কৃষকের ব্যক্তিগত স্বার্থ, উপার্জন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের উৎপাদন ও কৃষকদের দিনযাপনের অনিশ্চয়তা দূর করতেও ভারত সরকারকে সচেষ্ট হতে হবে। এ জন্য অঙ্গীকার থাকতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে দেরি না করেই। ভারতের সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।

অমর্ত্য সেন আরও বলেছেন, শুধু শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী হলেই অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যবৃদ্ধি হয় না। একই সঙ্গে যেন আমজনতার ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে সরকারকে। না হলে প্রবৃদ্ধির হার টেনে তোলা সম্ভব নয়।

ভারতের ইংরেজি টেলিভিশন চ্যানেল এনডিটিভিকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে অমর্ত্য বলেছেন, ‘কৃষকদের আন্দোলনকে সহানুভূতির চোখে দেখতে হবে। খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা ও সাইক্লোনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে কৃষকদের যে রুটিরুজির সমস্যা এবং জীবনযাপনের অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে, তা সরকারকে বুঝতে হবে। সেটা মোকাবিলায় সরকারকে আগেভাগে কল্যাণমূলক পরিকল্পনা এবং তার জন্য অর্থ বরাদ্দ করে রাখতে হবে।’ অমর্ত্য সেন বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, সরকার কেন কৃষকদের এসব ব্যাপারে এতটা অসংবেদনশীল হয়।

নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ভবিষ্যৎ নিয়ে সুখের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকাটা সুবিবেচনার লক্ষণ নয়। বরং কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আগেভাগে তৈরি থাকাটাই সুবিবেচক অর্থনীতির প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত।

এই পর্যায়ে উপস্থাপক প্রণয় রায় জিজ্ঞাসা করেন, বলা হচ্ছে ভারতের এই নতুন কৃষি আইন বাজারমুখী সংস্কার। ফলে এর বিরোধিতা করা মানে বাজার অর্থনীতির বিরোধিতা।

অমর্ত্যর কথায়, ‘কৃষকদের ব্যক্তিগত স্বার্থের দিকে নজর রাখতে গেলে কেন বাজার অর্থনীতির বিরোধিতা করা হবে, এটা বোধগম্য হচ্ছে না। যদিও আমাকে অনেক দিন ধরেই বাজারবিরোধী আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে আমি মনে করি, কোনো দেশের আর্থিক সমৃদ্ধির জন্য বাজার অর্থনীতি বড় ভূমিকা নিতে পারে। তবে তার জন্য ভারতের মতো কৃষিনির্ভর দেশের কৃষকদের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া উপেক্ষা করার প্রয়োজন হয় না। উপেক্ষা করলে বরং হিতে বিপরীতই হবে। দেশের জিডিপির হার টেনে তোলা সম্ভব হবে না।’

অমর্ত্য সেন আরও বলেন, ‘আমার অবস্থান অ্যাডাম স্মিথের মতোই। তিনি বলেছিলেন, বাজারব্যবস্থা সফল হতে গেলে স্বাস্থ্যকর বাজার প্রয়োজন। শুধু তা-ই নয়, রাষ্ট্রকেও স্বাস্থ্যকর হতে হবে। অর্থাৎ তাকে জনগণের স্বার্থ আমলে নিতে হবে। ১৮ শতকে স্মিথের সেই কথার ব্যত্যয় ঘটছে না।’

‘আমার অবস্থান অ্যাডাম স্মিথের মতোই। তিনি বলেছিলেন, বাজারব্যবস্থা সফল হতে গেলে স্বাস্থ্যকর বাজার প্রয়োজন। শুধু তা-ই নয়, রাষ্ট্রকেও স্বাস্থ্যকর হতে হবে।
অমর্ত্য সেন

উপস্থাপক প্রণয় রায় এ সময় বলেন, ‘অভিযোগ করা হচ্ছে, কৃষকেরা নিজ স্বার্থে পরিবর্তন চাইছেন না।’ জবাবে অমর্ত্য সেন বলেন, নিজ স্বার্থের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হওয়া পাপ নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পাঞ্জাবের এই সংগ্রামী কৃষকদের খালিস্তান আন্দোলনের কর্মী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। অথচ বাস্তবে তাঁদের সঙ্গে এর যোগ নেই।

মহামারির ধাক্কায় ভারত গত বছর প্রথম আপাত মন্দার কবলে পড়ে (‘টেকনিক্যাল রিসেশন’) পরপর দুটি প্রান্তিকে জিডিপির সংকোচন হলেই অর্থনীতির পরিভাষায় ‘আপাত–মন্দা’ বলা হয়।

তবে সেখান থেকে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ভারতীয় অর্থনীতি। ২০২০ সালের শেষ প্রান্তিকেই আর্থিক ‘মন্দা’ পেছনে ফেলে এসেছে ভারত। উৎপাদন, অবকাঠামো, পরিষেবা, রপ্তানি থেকে সব সূচকে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির ইঙ্গিত মিলেছে। অর্থনীতিবিদেরাও একমত, আর পেছনে তাকানোর অবকাশ নেই। আর্থিক গতিবৃদ্ধির মতো সামগ্রিক পরিস্থিতি পুরোপুরি প্রস্তুত। একই সঙ্গে শেয়ারবাজারও বেশ চাঙা।

যদিও অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘শেয়ার সূচক বাড়ল কি বাড়ল না, তার ওপর দেশের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি নির্ভর করে না। সেটা বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্যও চড়তে পারে। শেয়ারবাজার হয়তো আগামী দিনেও উঠবে। তবে দেখতে হবে, আমজনতার ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে কি না। দেশে উৎপাদিত পণ্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অভাবে বাজারে পড়ে থাকছে কি না। সেটা হলে বিপদ। তাহলে শেয়ারবাজার চড়লেও জিডিপির হার টেনে তোলা সম্ভব হবে না।’