কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বিশ্বের সব দেশের সরকারকেই ঋণ করতে হচ্ছে। যুক্তরাজ্য সরকারের ঋণ ইতিমধ্যে জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনীতিবিদেরা সাধারণত ঋণের বোঝা বেশি না বাড়ানোর পক্ষে, কিন্তু কোভিড-১৯-এর মতো সংকটে তাঁরা সেই প্রথাগত অবস্থান থেকে সরে আসেন।
দ্য ইকোনমিস্ট–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ মাত্রার ঋণও টেকসই হতে পারে—অর্থনীতিবিদদের মধ্যে নতুন চিন্তার উদয় হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে নতুন ঐকমত্য।
১৮১৫ সালে নেপালিয়নীয় যুদ্ধের পর যুক্তরাজ্য সরকারের ঋণ দাঁড়িয়েছিল জিডিপির ১৬৪ শতাংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঋণ ছিল আরও বেশি—জিডিপির ২৫৯ শতাংশ। ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, সরকার ঋণ করেছে মূলত যুদ্ধের ব্যয় বহন করতে। তবে সাম্প্রতিক অতীতে দেখা যায়, অর্থনীতিকে ঠিক ধারায় রাখতে সরকার ঋণ করছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বন্ড ছাড়ার প্রবণতা বা সরকারের ঋণ করার প্রবণতা অনেকটাই কমে আসে। কিন্তু প্রয়োজন মেটাতে সরকারকে ঋণ করতেই হয়। ১৯৭০-এর দশকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে উচ্চ পরিমাণের সরকারি ঋণকেও চিহ্নিত করা হয়।
২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর সরকারের ঋণ আবার বাড়তে শুরু করে। ২০০৭ সালে যেখানে উন্নত দেশগুলোর সরকারি ঋণ ছিল জিডিপির ৭৪ শতাংশ, ২০১৭ সালে তা দাঁড়ায় ১০৫ শতাংশ। উদীয়মান দেশগুলোতে ২০০৭ সালে এই হার ছিল জিডিপির ৩৫ শতাংশ, ২০১৭ সালে তা দাঁড়ায় ৪৮ শতাংশ।
এই পরিস্থিতিতে দেশে দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সরকারগুলো কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি অবলম্বন করে। কিন্তু অর্থনৈতিক দুর্বলতার সময় কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্তই করে কেবল। খারাপ সময়ে রাজস্ব আয়ও আশানুরূপ হয় না। ফলে কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি কার্যকর হয় না।
২০১৯ সালে আইএমএফের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ অলিভিয়ের ব্লানশাদ এক যুগান্তকারী বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যা ধারণা করি, সরকার চাইলে তার চেয়েও অনেক বেশি ঋণ নিতে পারে।’ ব্লানশাদ দেখলেন, সরকারি বন্ডের সুদহার কমছে। এতে কিছু দেশের পক্ষে ঋণ করা অত ব্যয়বহুল নয়। একই সময়ে আবার প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের গত ৩০ বছরের নমিনাল জিডিপি প্রবৃদ্ধি বন্ডের সুদহারের চেয়ে বেশি। এই পরিস্থিতিতে সরকার অতিরিক্ত ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখলে ঋণ পরিশোধ কঠিন কিছু নয়। গাণিতিকভাবে ব্যাপারটা সোজাসাপ্টা হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে।
ব্লানশাদের সেই যুগান্তকারী বক্তৃতার এক বছরের মধ্যেই করোনাভাইরাসের হানা। শুরু হয় ইতিহাসের বৃহত্তম ঋণ গ্রহণ প্রক্রিয়া। তবে সব দেশ একই পরিমাণে ঋণ করতে পারে না। বেশি ঋণের আবার ঝুঁকিও আছে। সুদহার যেকোনো সময় বেড়ে যেতে পারে। সাধারণত বন্ড ও মর্টগেজের সুদহার চাহিদার ওপর নির্ভর করে। সঞ্চয়ের প্রবণতা বাড়লে সুদহার কমবে। এতে বয়স্ক ও অবসরপ্রাপ্ত মানুষের আয় কমে যায়। তবে সুদহার যেকোনো সময় বাড়তে পারে। সে জন্য বেশি ঋণ করলে অসুবিধা।
এই মুহূর্তে বাজারে টাকার সরবরাহ সচল রাখতে সরকারের পক্ষে ঋণ করা ছাড়া উপায় নেই। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জি ঋণ করে হলেও মানুষের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার পরামর্শ দেন, কারণ অর্থনীতি সচল রাখাই মূল কথা।
কিন্তু সেটা কত দিন সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে বলে মনে করে দ্য ইকোনমিস্ট। ঋণ পরিশোধ করতে সরকারকে রাজস্ব আদায় করতে হবে। অর্থনীতি সচল না থাকলেও আবার রাজস্ব আদায় হবে না। তাই এ নিয়ে উভয়সংকট থেকে যায়। বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৯ শতাংশের মতো, সম্ভব সরকার সে কারণেই ব্যাংক ঋণনির্ভর প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে।