সারা বিশ্বে অর্থনীতিবিদেরা বরাবরই আয়ের বৈষম্য কমানোর তাগিদ দিয়ে আসছেন। তা সত্ত্বেও দেশে দেশে আয়ের পার্থক্য বাড়ছে। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ১০০টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) সঙ্গে অধস্তন কর্মীদের বেতনে চাঞ্চল্যকর পার্থক্যের তথ্য উঠে এসেছে। এতে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার শতাংশ পার্থক্য ধরা পড়েছে। আরেক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, ১৯৭৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশটিতে সাধারণ কর্মীদের বেতন যেখানে গড়ে মাত্র ১৮% বৃদ্ধি পেয়েছে, সেখানে সিইওদের বেতন ১,৩২২% বেড়েছে!
যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও অধস্তন কর্মীদের মধ্যে বেতনের যে বৈষম্য, তা রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। শুনলে আপনার মনও আঁতকে উঠবে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশটির বৃহত্তম ১০০টি কোম্পানির সিইওরা তাঁদের অধস্তন কর্মচারীদের তুলনায় বছরে গড়ে ১২ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার বেশি বেতন পান, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১১ কোটি টাকা। সমীক্ষাটি করেছে চাকরি খোঁজার ওয়েবসাইট লেনসা। নতুন সমীক্ষা করতে গিয়ে তারা ফোর্বস গ্লোবাল ২০০০-এর তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করেছে।
এটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের বড় কোম্পানিগুলোর সিইওদের সঙ্গে কর্মচারীদের বেতনের ক্রমবর্ধমান ব্যবধানের সর্বশেষ উদাহরণ। এর আগে গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক তথা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিক পলিসি ইনস্টিটিউট (ইপিআই) জানিয়েছিল, ১৯৭৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত সার্বিকভাবে দেশটিতে সাধারণ কর্মীদের বেতন যেখানে গড়ে মাত্র ১৮ শতাংশ বেড়েছে, সেখানে সিইওদের বেতন বেড়েছে ১ হাজার ৩২২ শতাংশ।
লেনসার সমীক্ষায় সিইওর সঙ্গে কর্মীদের গড় বেতনে সবচেয়ে বড় ব্যবধানটি ধরা পড়েছে বেভারেজ জায়ান্ট তথা বহুজাতিক কোমল পানীয় কোম্পানি কোকাকোলায়। ২০২০ সালে কোম্পানিটির সিইও জেমস কুইন্সের বার্ষিক মূল বেতনের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশের ১৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকার মতো। অথচ তখন কোম্পানিটির কর্মীদের গড় বার্ষিক বেতন ছিল মাত্র ১১ হাজার ৩৪২ ডলার বা ৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ কোকাকোলার কর্মীদের গড় বেতনের তুলনায় সিইওর বেতন ১৪ হাজার শতাংশের বেশি।
লেনসার সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, কোকাকোলার সিইও জেমস কুইন্সের বার্ষিক বেতন প্রতিষ্ঠানটির ১৪১ জন কর্মীর মোট বেতনের সমান। অবশ্য বেতনের বাইরেও তিনি বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা পান। যেমন ২০২০ সালে তিনি বেতনের সঙ্গে কোম্পানির শেয়ার ও পুরস্কার মিলিয়ে মোট ১ কোটি ৮৩ লাখ ডলার পেয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কফি হাউস স্টারবাকসের সিইও কেভিন জনসনের বার্ষিক মূল বেতন ১৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার, যা প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের ১২ হাজার ১১৩ ডলারের গড় বেতনের চেয়ে ১২ হাজার ৬১৭ শতাংশ বেশি। স্টারবাকস হলো বিশ্বের বৃহত্তম কফি হাউস চেইন।
চিপোটল মেক্সিকান গ্রিল নামের বহুজাতিক রেস্তোরাঁর কর্মচারীদের বার্ষিক গড় বেতন ১৪ হাজার ১৫৫ ডলার। অথচ প্রতিষ্ঠানটির সিইও ব্রায়ান নিকোল বছরে পান ১২ লাখ ডলার। কর্মচারীদের গড় বেতনের তুলনায় তিনি ৮ হাজার ৩৭৮ শতাংশ বেশি অর্থ পান।
বহুজাতিক গণমাধ্যম ভায়াকমের সিইও রবার্ট বাকিশের বার্ষিক মূল বেতন ৩০ লাখ ডলার, যা প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীদের গড় বেতন ৩৯ হাজার ১১০ ডলারের তুলনায় ৭ হাজার ৫৭১ শতাংশ বেশি।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্টের কর্মচারীদের গড় বেতন ২০ হাজার ৯৪২ ডলার। এর চেয়ে ৫ হাজার ৯৭৪ শতাংশ বেশি বেতন নেন প্রতিষ্ঠানটির সিইও ডগ ম্যাকমিলন। তাঁর বার্ষিক বেতন ১২ লাখ ৭০ হাজার ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় খুচরা দোকানের চেইন পরিচালনাকারী লোয়ের কোম্পানির সিইও মারভিন এলিসনের বার্ষিক বেতন ১৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার, যা প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীদের গড় বেতন ২৪ হাজার ৫৫৪ ডলারের তুলনায় ৫ হাজার ৮০৫ শতাংশ বেশি।
খুচরা বিক্রেতা টার্গেটের সিইও ব্রায়ান কর্নেল বছরে পান ১৪ লাখ ডলার। তাঁর এই বেতন কর্মীদের গড় বেতনের তুলনায় ৫ হাজার ৬০৬ শতাংশ বেশি। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা গড়ে ২৪ হাজার ৫৩৫ ডলার বেতন পান।
আরেক খুচরা বিক্রেতা ক্রোগারের কর্মচারীদের গড় বেতন ২৪ হাজার ৬১৭ ডলার। এর চেয়ে ৫ হাজার ৩৪৮ শতাংশ বেশি বেতন পান প্রতিষ্ঠানটির সিইও ডব্লিউ রডনি ম্যাকমুলেন। তাঁর বেতন ১৩ লাখ ৪০ হাজার ডলার।
বহুজাতিক প্রযুক্তি কোম্পানি অ্যাপলের সিইও টিম কুক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের গড় বেতনের চেয়ে ৫ হাজার ৯২ শতাংশ বেশি বেতন পান। কোম্পানিটি তাঁকে যেখানে ৩০ লাখ ডলার বেতন দেয়, সেখানে কর্মীদের দেয় মাত্র ৫৭ হাজার ৭৮৩ ডলার।
নির্মাণপণ্য ও পরিষেবা বিক্রেতা হোম ডিপোর কর্মচারীরা গড় ২৭ হাজার ৩৮৯ ডলার বেতন পান। তাঁদের চেয়ে ৪ হাজার ৬৪৬ শতাংশ বেশি বেতন পান হোম ডিপোর সিইও ক্রেইগ মেনেয়ার, যা পরিমাণে ১৩ লাখ ডলার।
লেনসার সমীক্ষা প্রতিবেদনটিতে যুক্তরাষ্ট্রের শুধু বড় কোম্পানিগুলোর বেশি বেতনের সিইওদেরই নয়, সেই সঙ্গে তুলনামূলক কম বেতন পাওয়া সিইওদের সঙ্গে কর্মীদের বেতনের পার্থক্যও তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, কোনো কোনো সিইওর বেতন কর্মীদের গড় বেতনের চেয়ে অনেক কম। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন বর্তমান বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক। বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইলন মাস্কের বেতন তাঁর প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের গড় বেতনের চেয়ে ৫৯ শতাংশ কম। টেসলার কর্মীদের বার্ষিক গড় মূল বেতন ৫৮ হাজার ৪৫৫ ডলার।
তবে সিইও হিসেবে ইলন মাস্কের নামমাত্র বেতন নেওয়ার বিষয়টিকে বিভ্রান্তিকর বলে মনে করা হয়। কারণ, কোম্পানি থেকে বেতন না নিলেও কিংবা নামমাত্র বেতন নিলেও তিনি কিন্তু শেয়ার আয় থেকে ঠিকই প্রচুর অর্থ পান। অর্থাৎ ইলন মাস্ক কোম্পানি থেকে যে অর্থ নেন, সেটি আসে শেয়ারবাজারের আয় থেকে। টেসলার শেয়ারহোল্ডাররা ২০১৮ সালে বিপুল ভোটে তাঁর জন্য শেয়ার আয়ের অর্থ নেওয়ার সুবিধা অনুমোদন করে। সে অনুযায়ী তিনি ৬৭০ কোটি ডলার পান। গত শনিবার তাঁর সম্পদের নিট মূল্য বেড়ে হয়েছে ২৬ হাজার ৬৪০ কোটি ডলার।
একইভাবে বিনিয়োগ গুরুখ্যাত বিলিয়নিয়ার তথা অতিধনী ওয়ারেন বাফেটের বেতনের সঙ্গে তাঁর প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের গড় বেতনের ব্যবধানও খুবই কম। তাঁর ক্ষেত্রেও হিসাবের বিভ্রান্তি রয়েছে। যেমন তিনি গত বছর নিজের কোম্পানি বার্কশায়ার হ্যাথওয়ে থেকে স্বাভাবিক মূল বেতন হিসেবে নেন এক লাখ ডলার। অথচ তাঁর প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের গড় বেতন ৬৮ হাজার ৫৪৩ ডলার। তার মানে কর্মীদের গড় মূল বেতনের তুলনায় বাফেটের মূল বেতন মাত্র ৪৬ শতাংশ বেশি! অবশ্য বার্কশায়ার হ্যাথওয়ের বার্ষিক সভার আগে শেয়ারহোল্ডারদের উদ্দেশে দেওয়া প্রক্সি স্টেটমেন্ট বা বিবৃতিতে ওয়ারেন বাফেটের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে কোম্পানি থেকে মোট ৩ লাখ ৮০ হাজার ডলার নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। গত শনিবার বাফেটের সম্পদের বর্তমান নিট মূল্য দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৪৯০ কোটি ডলার। সূত্র: সিএনবিসি ও ফোর্বস।