এসব ভবিষ্যদ্বাণী মিলবে?

ভবিষ্যৎ নিয়ে কে ভাবে না? ভাবে সবাই। কেউ ব্যক্তিগত ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন, কেউ আবার ভাবেন ভবিষ্যতের পৃথিবী নিয়ে। তাই বিশ্বে ভবিষ্যদ্বাণীরও অভাব নেই। কিছু কিছু আবার আশ্চর্যজনকভাবে পুরোপুরি মিলেও যায়। কিছু আবার মেলে না। তখন শুরু হয় ভবিষ্যতের বাণীর সঙ্গে বর্তমানের তুলনা।
২০১৯ সাল শেষের দ্বারপ্রান্তে, আসছে ২০২০। বছরটি নিয়েও ভবিষ্যদ্বাণী হয়েছে ঢের। কোনোটি ২০ বছর, কোনোটি আবার অর্ধশতাব্দী আগে! আসুন, দেখে নেওয়া যাক ২০২০ সাল নিয়ে এমনই কিছু ভবিষ্যদ্বাণী। ভেবে দেখুন তো, আগামী বছর এগুলো মিলবে কি না!

মিলবে ‘ব্যক্তিগত সহকারী’
বিশ্বের শীর্ষ ধনী বিল গেটস ১৯৯৯ সালে একটি বই লিখেছিলেন। বিজনেস অ্যাট দ্য স্পিড অব থট নামের সেই বইয়ে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন, অচিরেই সব মানুষের ব্যক্তিগত সহকারী মিলবে এবং সেই ডিভাইসটি হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন। ওই ডিভাইস সবার ই–মেইল দেখা থেকে শুরু করে বাজার সদাই—সবই করবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই কিন্তু মিলতে শুরু করেছে। আমাজন নিয়ে এসেছে অ্যালেক্সা, গুগল নিয়ে এসেছে সিরি। এসব স্মার্ট প্রযুক্তি দিন দিন আরও উন্নত হচ্ছে। হয়তো শিগগিরই ফলে যেতে পারে বিল গেটসের ভবিষ্যদ্বাণী। বিশ্লেষকদের ধারণা, সেই দিন আর বেশি দূরে নয়।

গড় আয়ু ১০০ হবে?
কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা বর্তমানে বসে ভবিষ্যৎ নিয়ে গবেষণা করেন। এঁরাই ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকেন। এঁদের বলা হয় ফিউচারিস্ট। এমনই একজন ফিউচারিস্ট হলেন রে কুরজওয়াইল। এই ব্যক্তি ১৯৯৯ সালেই বলেছিলেন যে ২০১৯ সালের মধ্যে নাকি পৃথিবীর মানুষের গড় আয়ু ১০০ বছর পার হবে। নিজের লেখা দ্য এজ অব স্পিরিচুয়াল মেশিনস নামক বইয়ে এই পূর্বাভাস দিয়েছিলেন তিনি। মূলত প্রযুক্তির অভাবিত উন্নতির কারণেই এই ঘটনা ঘটবে বলে ধারণা করেছিলেন তিনি। কিন্তু আদতে তা হয়নি। চলতি বছর বিশ্বব্যাপী মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৬ বছর। অবশ্য মার্কিন মুলুকের নাগরিকদের গড় আয়ু আরেকটু বেশি, তবে তা ১০০-এর ধারেকাছেও নেই। জাতিসংঘ আবার এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, বিশ্বব্যাপী মানুষের গড় আয়ু ৭৭ বছর পার হতেই নাকি ২০৫০ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে।

চীন হবে সবচেয়ে বড় অর্থনীতি
ফিউচারিস্ট পিটার শোয়ার্জ ও পিটার লাইডেন ১৯৯৭ সালে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। ‘দ্য লং বুম’ নামের ওই নিবন্ধে তাঁরা বলেছিলেন, ২০২০ সালের মধ্যে চীনা অর্থনীতি বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতিতে পরিণত হবে। এ–ও বলা হয়েছিল, অর্থনীতিতে সর্ববৃহৎ হওয়ার দৌড়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে। ২০১৯ সালের হিসাব বিবেচনায় নিলে বলাই যায় যে সেই লড়াই এখন যুদ্ধে (পড়ুন বাণিজ্যযুদ্ধ) রূপ নিয়েছে। যদিও এখনো বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি হতে পারেনি চীন। যুক্তরাষ্ট্র এখনো শীর্ষে আছে। তবে তার ঘাড়েই নিশ্বাস ফেলছে চীন। সাম্প্রতিক পূর্বাভাস বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যেই নাকি ট্রাম্পের দেশকে টপকে যেতে পারে চীন ও ভারত।
একই প্রবন্ধে শোয়ার্জ ও লাইডেন এ–ও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, চীন নাকি গণতন্ত্রের পথে হাঁটা শুরু করবে। এটি অবশ্য একেবারেই মেলেনি।

পৃথিবীতে মানুষ হবে ৮০০ কোটি
১৯৯৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট পূর্বাভাস দিয়েছিল যে ২০২০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে মানুষের মোট সংখ্যা ৮০০ কোটি স্পর্শ করবে। এই ইনস্টিটিউটের দাবি ছিল, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফ্রিকা মহাদেশ বৈশ্বিক জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখবে, যোগ করবে দেড় শ কোটি মানুষ। এই পূর্বাভাস কিন্তু অনেকটাই মিলেছে। জাতিসংঘের দেওয়া সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মোট জনসংখ্যা প্রায় ৭৭০ কোটি। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট সেই পূর্বাভাসে বলেছিল, আগামী ৩০ বছরে নাকি জনসংখ্যা বেড়ে যাবে আরও ২০০ কোটি।

রোগের রাজা হৃদরোগ-বিষণ্নতা
১৯৯৬ সালে হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক পূর্বাভাসে বলেছিল, ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বে রোগগ্রস্ততার শীর্ষ দুই কারণ হবে—হৃদরোগ ও বিষণ্নতা। এই দুই কারণেই বিশ্বব্যাপী বাড়বে অসুস্থতা, ঘটবে মানুষের মৃত্যু। এই ভবিষ্যদ্বাণীও প্রায় মিলে গেছে। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ রোগ হলো হৃদ্‌যন্ত্রসম্পর্কিত। তবে বিষণ্নতা এখনো ততটা ভয়ংকর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ভয়ংকর হতে কতক্ষণ?

বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়বেই
জলবায়ু পরিবর্তনসংশ্লিষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী সাধারণত অনেক বছরের হিসাব ধরে করা হয়। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) ১৯৯৫ সালের এক প্রতিবেদনে বলেছিল, ২১০০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রায় ৩ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট বাড়বে, একই সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে পারে ২০ ইঞ্চি। ২০১৯ সালের শেষলগ্নে এসে দেখা যাচ্ছে, এমন ঘটনা মোটেও অসম্ভব নয়। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক উষ্ণতা এরই মধ্যে বেড়ে গেছে ১ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি। আর ১৯৯২ সালের পর এখন পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে ৩ ইঞ্চির বেশি। ২১০০ সাল নাগাদ না জানি কী হয়!

বরিসেই ব্রেক্সিট
চলতি বছর যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে আলোচিত নাম প্রধানমন্ত্রী হওয়া বরিস জনসন। জনগণের ম্যান্ডেট আদৌ তিনি পাবেন কি না, তা নিয়ে দোলাচল ছিল। অথচ ১৯৯৭ সালেই ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইনডিপেনডেন্ট বলে দিয়েছিল, অন্য কেউ নয়, একমাত্র বরিস জনসনেই ব্রেক্সিট বাস্তবায়িত হবে। আর এটি হবে ২০২০ সালের মধ্যেই। অথচ ১৯৯৭ সালে বরিস পরিচিত ছিলেন একজন সম্পাদক ও কলামিস্ট হিসেবে। পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ হওয়ার তেমন লক্ষণ তখনো দেখা যায়নি। কিন্তু সেই ভবিষ্যদ্বাণী প্রায় মিলিয়ে দিয়ে এবার প্রধানমন্ত্রী বনে গেছেন বরিস জনসন। ব্রেক্সিট বাস্তবায়নই তাঁর প্রধান প্রতিশ্রুতি।

দুনিয়া হবে কম্পিউটারের
আবার রে কুরজওয়াইল। এই বিখ্যাত ফিউচারিস্ট ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, কাগজের বইয়ের দিন শেষ হয়ে যাবে। একই সঙ্গে ২০১৯ সালের মধ্যে কম্পিউটার মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাবে, সবকিছুতেই থাকবে কম্পিউটার চিপ। বর্তমানে অবশ্য কম্পিউটারের একাধিপত্য লক্ষণীয়। টেবিল-চেয়ার থেকে হাতঘড়ি—সবকিছুতেই আছে কম্পিউটার। তবে বইয়ের দিন শেষ হয়নি। ২০১০ সালের পর কাগুজে বইয়ের বৈশ্বিক বাজারে কিছুটা ভাটা পড়লেও আবার তাতে জোয়ারের টান দেখা যাচ্ছে। শুধু মার্কিন মুলুকেই ২০১৮ সালে বিক্রি হয়েছে প্রায় ৬৮ কোটি কপি বই। কে বলে, ছাপা বইয়ের দিন ফুরিয়েছে!

জাতীয়তাবাদ ধূসর হবে!
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির শিক্ষক ইথিয়েল ডে সোলা পুল ১৯৬৮ সালে বলেছিলেন, ২০১৮ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জাতীয়তাবাদের আবেদন কমে যাবে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে বলতে হয়, ঘটেছে তার ঠিক উল্টোটা। জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলেই রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, নরেন্দ্র মোদি ও বরিস জনসনের মতো লোকরঞ্জনবাদী নেতারা। ভোটারদের আকৃষ্ট করতে তাঁদের অন্যতম অস্ত্র জাতীয়তাবাদ। আর ক্রমবর্ধমান অভিবাসন সমস্যা, বিশ্বায়নের কুপ্রভাব ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এই উগ্র জাতীয়তাবাদের লেলিহান শিখায় ঘি ঢালছে। অথচ এই ভবিষ্যদ্বাণী মিললে কী ভালোই না হতো!

তথ্যসূত্র: ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ইউএসএ টুডে, সায়েন্স ডেইলি, ওয়াশিংটন পোস্ট ও ওয়্যারড