আরেকটি বিশাল আর্থিক নথিপত্রের ফাঁসের ঘটনায় শত শত বিশ্বনেতা, রাজনীতিবিদ ও সেলিব্রিটিদের আর্থিক গোপনীয়তা উন্মোচিত হয়েছে। প্যান্ডোরার বাক্স থেকে বের হয়ে গেছে করস্বর্গ হিসেবে পরিচিত পানামা, দুবাই, মোনাকো, সুইজারল্যান্ড ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের মতো দেশ ও অঞ্চলের কোম্পানিতে বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যে অর্থ রেখেছেন ও গোপন লেনদেন করেছেন, সেই তথ্য। নতুন এই ফাঁসের ঘটনার নাম দেওয়া হয়েছে প্যান্ডোরা পেপারস। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ, চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রে বাবিসের মতো নেতাদের নাম উঠে এসেছে এতে।
বিশ্বব্যাপী অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জোট ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) উদ্যোগে ৬০০ জনের বেশি সাংবাদিক এসব নথি বিশ্লেষণ করেন। এটি হলো সর্বশেষ নথি ফাঁসের ঘটনা। তবে এর আগেও নথি ফাঁসের ঘটনা সাড়া ফেলেছে বিশ্বে।
গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর আর্থিক লেনদেনের গোপন নথি প্রকাশ করে যেন বোমা ফাটায় আইসিআইজে। এতে দুই ট্রিলিয়ন (এক ট্রিলিয়নে এক লাখ কোটি) ডলারের বেশি সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের তথ্য উঠে এসেছে। লেনদেনগুলো ঘটে ১৯৯৯ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে। এর মধ্যে ফ্রিডম অফ ইনফরমেশন (এফওআই) ও অন্যান্য উৎসের মাধ্যমে পাওয়া ১৭ হাজার ৬৪১টি রেকর্ডও অন্তর্ভুক্ত ছিল। যে পরিমাণ অর্থের সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য উঠে এসেছে, তা দিয়ে বাংলাদেশের ৫ লাখ কোটি টাকার ৩৪টি বাজেট করা যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশটির আর্থিক দপ্তর অর্থাৎ ডিপার্টমেন্ট অব ট্রেজারির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্কের (ফিনসেন) কাছে বাধ্যতামূলকভাবে লেনদেনের তথ্য জানাতে হয়। ফিনসেনের সেসব তথ্য থেকেই সন্দেহজনক লেনদেনের পুরো নথি প্রথমে ফাঁস করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজফিড নিউজ। বাজফিড পরে তা দিয়েছে আইসিআইজের কাছে। আইসিআইজের ৪০০ জনের দল এ নিয়ে ১৬ মাস ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুসন্ধান চালায়। যেহেতু ফিনসেনের তথ্য ফাঁস হয়েছে, আইসিআইজে তাই এর নাম দেয় ‘ফিনসেন ফাইলস’।
ফিনসেন ফাইলস ফাঁসের তিন বছর আগে ঘটে প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারি। ২০১৭ সালের নভেম্বরে হইচই ফেলে এই ঘটনা। ফাঁস হয় ১ কোটি ৩৪ লাখ নথি। উঠে আসে ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম। ফাঁস হওয়া গোপন নথিতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যুক্তরাজ্যের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ, প্রিন্স চার্লস, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, কলম্বিয়ার রাজনীতিবিদ হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস ও সাবেক মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী উইলবার রসের মতো ব্যক্তির নাম ছিল।
ফাঁসের এ ঘটনায় অনেকে কলঙ্কিত হন, অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও হয়। এ কাণ্ডের সূত্রপাত করেন জার্মান সাংবাদিক বাস্তিয়ান ওবেরমেয়ার, সঙ্গে ছিলেন ফ্রেডরিখ ওবেরমেয়ার। এর আগে বাস্তিয়ান ওবেরমেয়ার পানামা পেপারসের মতো ফাঁস কাণ্ড ঘটান। এটি প্রকাশ করে আইসিআইজে। প্যারাডাইস পেপারসে বেশির ভাগ তথ্যই ছিল বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদদের, যাঁরা কর থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন ট্যাক্স হেভেনে (কর দিতে হয় না কিংবা খুবই নিম্ন হারে কর দেওয়া যায় এমন দেশ) বিনিয়োগ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছিলেন। তাই এই কেলেঙ্কারির নাম দেওয়া হয় ‘প্যারাডাইস পেপারস’। এতে গোপনে বিপুল পরিমাণ অর্থ করস্বর্গ হিসেবে পরিচিত দেশ ও অঞ্চলের অফশোর কোম্পানিতে বিনিয়োগের তথ্য বেরিয়ে আসে। নথিতে যুক্তরাজ্যের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিবরণ ছিল, ফর্মুলা ওয়ান চ্যাম্পিয়ন লুইস হ্যামিল্টন কীভাবে তাঁর বিলাসবহুল জেটের কর এড়িয়ে গেছেন সে তথ্য ছিল।
পানামার আইনি প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ছিল গোপনীয়তা রক্ষাকারী হিসেবে। তবে সেখান থেকেই ২০১৬ সালে ফাঁস হয়েছে ১ কোটি ১ লাখ ৫০ হাজার নথি। বলা হয় বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁসের ঘটনা এটি। ২ লাখ ১৪ হাজার ৪৮৮টি অফশোর প্রতিষ্ঠানের ওই নথি ফাঁস হওয়ার ঘটনাই পানামা পেপারস নামে পরিচিত। ২০১৫ সালে মোসাক ফনসেকার কাছ থেকে জার্মান দৈনিক জিটডয়েচ সাইতং-এর হাতে আসে বিপুল তথ্য। একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি জার্মান সাংবাদিক বাস্তিয়ান ওবেরমেয়ারের হাতে এসব নথি তুলে দেন। এতে বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির অফশোর লেনদেনের তথ্য ছিল। জার্মান সংবাদপত্রের হাতে এসব দলিল আসার পর, তারা তা আইসিআইজে জানায়। এরপর আইসিআইজে তা শেয়ার করে বিশ্বের প্রায় ১০০টি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। তাদের এক বছরের অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে ২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল ফাঁস করা হয় কর ফাঁকির এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। অফশোর ব্যবসা বৈধ হলেও সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে যে মোসাক ফনসেকা যেসব কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে সেবা দিয়েছে, সেগুলো মূলত কর ফাঁকি ও জালিয়াতির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে।
নথিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের নিকটাত্মীয়দের নাম আসে। এ তালিকায় আরও আছে সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ বিন আবদুল রহমান আল সৌদ, মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের এক ছেলে এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দুই ছেলে ও এক মেয়ের নাম। রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের পাশাপাশি ফুটবল তারকা লিওনেল মেসি, ভারতের চলচ্চিত্রজগতের খ্যাতিমান অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন ও তাঁর পুত্রবধূ অভিনেত্রী ঐশ্বরিয়া রাইয়ের নামও পাওয়া যায় ওই নথিতে।
পরবর্তী সময়ে ‘জন ডো’ নামের এক ব্যক্তির নাম উঠে আসে এই ফাঁসের ঘটনায়। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, তিনি কখনো কোনো গোয়েন্দা সংস্থা বা সরকারের হয়ে কাজ করেননি। তাঁদের কারও সঙ্গেই সরাসরি বা চুক্তিভিত্তিক কোনো কাজে তিনি জড়িত নন। কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, বিশ্বব্যাপী দিনের পর দিন চলতে থাকা অন্যায় কাজগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরতেই ব্যক্তিগত দায় ও তাগিদ থেকে তিনি এ কাজ করেছেন। তবে এই ব্যক্তির সত্যিকারের পরিচয় এখনো অজানা।
এটি ছিল সাংবাদিকদের অনুসন্ধানের বেরিয়ে আসা বড় ধরনের কর ফাঁকির ঘটনা। ব্রিটিশ বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসির জ্ঞাতসারে এ কাণ্ড ঘটে। তাদের সুইস সাবসিডিয়ারি এইচএসবিসি প্রাইভেট ব্যাংকের (সুসি) মাধ্যমে এটি বাস্তবায়িত হয়। সুইস ব্যাংকিং ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ফাঁস কাণ্ড হিসেবে পরিচিত এ ঘটনা। ফরাসি কম্পিউটার বিশ্লেষক ও ব্যাংকটির সাবেক কর্মী হার্ভে ফ্যালসিয়ানি এইচএসবিসি ব্যাংকের ১ লাখ ব্যক্তি ও ২০ হাজার অফশোর কোম্পানির হিসাব অনুসন্ধান করে এই কর ফাঁকির ঘটনার হদিস পান। অভিযোগ, এইচএসবিসির জেনেভা শাখার মাধ্যমে ১৮০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ইউরো হাতবদল হয়েছে। ২০০৬ সালের নভেম্বর থেকে ২০০৭ সালের মার্চ মাসের মধ্যে এই লেনদেন হয়েছে।
এটিও আইসিআইজের তদন্তের ঘটনা ছিল। ২০১৪ সালের নভেম্বরে বহুজাতিক পরামর্শক সেবা প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউসকুপার্সের কিছু দলিল ফাঁস হয়। এখানে দেখা যায় বড় বড় কোম্পানি লুক্সেমবার্গের কর ব্যবস্থাকে অবৈধভাবে ব্যবহার করছে, যাতে করে তাদের কর প্রদানের অঙ্ক অনেক কমিয়ে আনা যায়। আইসিআইজে জানায়, বহুজাতিকেরা লুক্সেমবার্গের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা সঞ্চয় করেছে, কখনো কখনো ১ শতাংশের নিচে কম কর দিয়ে। লুক্সেমবার্গে ১ হাজার ৬০০–এর বেশি বহুজাতিক সংস্থা ছিল।
এটি ছিল পানামা পেপারসের আকারের প্রায় ১০ ভাগের ১ ভাগ। তবে পরে এটিই হয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক কর জালিয়াতির সবচেয়ে বড় ফাঁসের ঘটনা। ২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে এই তথ্য ফাঁস করে আইসিআইজে। প্রায় আড়াই লাখ ফাইল ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি কোম্পানির নাম এবং ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ এবং কুক দ্বীপপুঞ্জের মতো গোপন আস্তানায় নাম প্রথম প্রকাশ পায় এতে। রাশিয়া, চীন, আজারবাইজান, কানাডা, থাইল্যান্ড, মঙ্গোলিয়া ও পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নানা কর তথ্য ফাঁস হয় এতে। তবে আইসিআইজে জানায় সব তথ্যই অবৈধ কর ফাঁকির তথ্য নয়।