মহামারি শুরুর পর ২০২০ সালের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের শীর্ষ ১০ জন ধনীর সম্মিলিত সম্পদ দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন ২১ হাজার নিম্ন আয়ের মানুষ মারা যাচ্ছেন।
বিশ্বে অতি ধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, আর তার যৌক্তিক পরিণতি হিসেবে সমাজে বৈষম্য বেড়েছে। কিছু মানুষের হাতে বেশি ধনসম্পদ জড়ো হওয়ার অর্থ হলো, অন্যদের সম্পদ কমে যাওয়া। দেখে নেওয়া যাক, গত এক দশকে বিশ্বে শতকোটি ডলারের মালিকের সংখ্যা কতটা বেড়েছে।
২০১০ সালে বিশ্বে মোট বিলিয়নিয়ার বা শতকোটি ডলারের মালিকের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১ জন। তাঁদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলার। এক দশক পরে ২০২০ সালে বিশ্বে অতি ধনী মানুষের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে—২ হাজার ৯৫ জন। আর তাঁদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ আট লাখ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক দশকে অতি ধনীর সংখ্যা যেমন দ্বিগুণ হয়েছে, তেমনি তাঁদের মোট সম্পদের পরিমাণও দ্বিগুণ হয়েছে।
২০২০ সালে কোভিড মহামারি শুরু হয়। ওই বছর কয়েক মাস বিশ্বের প্রায় সব দেশেই লকডাউন বা বিধিনিষেধ ছিল। বিশ্ব অর্থনীতি সংকুচিত হয় তখন। তাই ২০২০ সালে অতি ধনীর সংখ্যা ও তাদের মোট সম্পদ—উভয়ই কমেছে। ২০১৯ সালে অতি ধনীদের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ১৫৩ এবং তাঁদের হাতে থাকা সম্মিলিত
সম্পদের পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলার।
আবার ২০১৮ সালে অতি ধনীর সংখ্যা এবং তাঁদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ২০১৯ সালের চেয়েও বেশি ছিল। ওই বছর অতি ধনীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ২০৮ জন এবং তাঁদের
মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ১০ হাজার কোটি ডলার। অর্থাৎ ২০১৮ সালের পর থেকেই বিশ্ব অর্থনীতিতে একধরনের মন্দাভাব দেখা যাচ্ছে।
যাঁদের আমরা ধনী বলি, তাঁদের সংখ্যা প্রত্যাশিত হারের তুলনায় বেশি নয়। কিন্তু অতি ধনীর সংখ্যা বেশখানিকটা বেশি। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করলে প্রত্যাশিত হারের প্রায় দেড় গুণ। অন্যভাবে বললে, ভারতের আর্থিক পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি বজায় রেখে দেশে যতজন অতি ধনী থাকা উচিত, অতি ধনীর প্রকৃত সংখ্যা তার তুলনায় বেশি।
উন্নত দেশে অতি ধনীরা থাকবেন, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু ইদানীং ভারত ও চীনের মতো দেশেও অতি ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ২০১০ সালের এক সমীক্ষায় জানা গেছে, ভারতের মতো অর্থনীতির যে অংশটি কালো টাকায় চলে, যাকে ছায়া-অর্থনীতি বলা হয়, তার অনুপাত অন্তত ২০ শতাংশ, যেখানে আরও সচ্ছল দেশগুলোতে তা ১০ শতাংশের বেশি নয়। সবাই মনে করেন, ভারতের ক্ষেত্রে এই অনুপাত আসলে ২০ শতাংশের অনেক বেশি। ইউপিএ সরকারের নির্দেশে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিন্যান্স অ্যান্ড পলিসি ভারতের কালো অর্থনীতি বিষয়ে যে প্রতিবেদন তৈরি করেছিল, ২০১৩ সালে সরকারের হাতে তা জমা পড়ার পরও চিদাম্বরম বা অরুণ জেটলি তা সংসদে পেশ করতে দেননি। সম্প্রতি জানা গেছে, সেই প্রতিবেদনে নাকি বলা হয়েছে, ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন যত, দেশের কালো অর্থনীতির মাপ তার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ। এই ৭৫ শতাংশের হিসাব একেবারে কথার কথা বলে উড়িয়ে দেওয়া মুশকিল। ফলে ভারতে অতি ধনীদের আসল সংখ্যা হিসাবের চেয়ে বেশিই হবে। ফলে এসব দেশে বৈষম্যের হার বেশি বলেই ধরে নেওয়া যায়।
গত এক দশকে ধনী তালিকার উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ধনীদের তালিকায় ভারতীয় ও চীনাদের সংখ্যা বৃদ্ধি। ২০১০ সালে ভারতীয়
অতি ধনীর সংখ্যা ছিল ৪৯ জন, তাঁদের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ২১০ কোটি ডলার। আর এক দশক পরে ২০২০ সালে
ভারতীয় অতি ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১০২ জন, তখন তাঁদের মোট সম্পদের পরিমাণ ৩১ হাজার ২৬০ কোটি ডলার। অর্থাৎ এই সময়ে ভারতীয় অতি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ
এবং তাঁদের মোট সম্পদ বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি।
অন্যদিকে ২০১০ সালে চীনা অতি ধনীর সংখ্যা ছিল ৬৪ জন, আর তাঁদের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৩২০ কোটি ডলার। ১০ বছর পর চীনা অতি ধনীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮৯ জন এবং তাঁদের মোট সম্পদের পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার।
এদিকে করোনা মহামারিতে অনেক মানুষ দরিদ্র হয়েছেন। কিন্তু এই সময়ে বিশ্বের ধনকুবেরদের সম্পদ আরও বেড়েছে বলে দাতব্য সংস্থা অক্সফামের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে। বলা হয়েছে, মহামারি শুরুর পর ২০২০ সালের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের শীর্ষ ১০ জন ধনীর সম্মিলিত সম্পদ দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন ২১ হাজার নিম্ন আয়ের মানুষ মারা যাচ্ছেন।
অর্থাৎ অতি ধনীর সংখ্যা ও সম্পদ বৃদ্ধি যে বিশ্বমানবতার জন্য সুখকর সংবাদ নয়, সে বিষয়ে সবাই কমবেশি একমত। এখন বিশ্বমানবতার সংগ্রাম তাই অসাম্যের বিরুদ্ধে।