কর্মজীবী মায়েদের একহাতে সংসার ও চাকরি সামলানো পৃথিবীর সবখানেই কঠিন। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি যথেষ্ট শক্তিশালী হলেও কর্মজীবী মায়েদের দুটি সামলাতে গিয়ে রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠে যাওয়ার জোগাড় হয়।
তবে স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়া থাকলে সেই বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়া অনেকটা সহজ হয়। সম্প্রতি বিজনেস ইনসাইডারে নিউইয়র্ক সিটিতে বসবাসরত মেলিসা পেট্রো নামের এক নারীর লড়াইয়ের গল্প উঠে এসেছে। সন্তান জন্মের আগে তিনি পূর্ণকালীন ফ্রিল্যান্স লেখক হিসেবে কাজ করতেন। আর তাঁর স্বামী ছিলেন ডিজিটাল মিডিয়ার পরামর্শক। সন্তান জন্মের আগে পারিবারিক খরচ তাঁরা সমানভাবে মেটাতেন।
কিন্তু মেলিসা অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর সবকিছু বদলে যায়। তাঁর ভাষায়, সমতামূলক সম্পর্ক জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। মেলিসা তখন হিসাব করে দেখেন, ফ্রিল্যান্স কাজ করে বছরে যা উপার্জন হয়, তা দিয়ে পূর্ণকালীন শিশুযত্নের খরচও ওঠানো দায়। সে জন্য তিনি স্বামীকে এক অদ্ভুত প্রস্তাব দেন: সন্তানের দেখভাল করার জন্য লোক নিয়োগ না দিয়ে বা চার মাস বয়সী শিশুকে দিবাযত্ন কেন্দ্রে না পাঠিয়ে তিনি নিজেই সন্তানের দেখাশোনা করবেন, বিনিময়ে স্বামী তাঁকে ঘণ্টায় ১৫ ডলার করে দেবেন। এ ক্ষেত্রেও খরচ ভাগাভাগি করেন তাঁরা। পাশাপাশি নিজের ব্যক্তিগত অন্যান্য খরচ মেটাতে তিনি খণ্ডকালীন ফ্রিল্যান্সিং চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু প্রথমবার মা হওয়ার কারণে মেলিসা ঠিক বুঝতে পারেনি ঝক্কি ঠিক কতটা। এই রুটিন চালু করার পর তিনি দেখলেন, সন্তানের দেখাশোনাসহ গৃহস্থালির যাবতীয় কাজ করার পর ফ্রিল্যান্সিং তো দূরের কথা, গোসল করারই সময় থাকে না। কাজ পাওয়া সমস্যা ছিল না, কিন্তু সময়মতো তা শেষ করাই ছিল কঠিন। আর শিশু একটু বড় হওয়ার পর ঘুম কমে যায় এবং সে আরও চঞ্চল হয়ে ওঠে। তখন কাজ করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। তাঁর জীবনে নেমে আসে এক অব্যক্ত অবসাদ।
তবে শেষমেশ স্বামীর সহায়তায় সেই হতাশা ও অবসাদ কাটিয়ে ওঠেন মেলিসা। তাঁর দুরবস্থা দেখে স্বামী পরিবারের খরচ বেশি হারে দিতে শুরু করেন। পাশাপাশি মেলিসার অনুরোধের অপেক্ষা না করে শিশুর যত্ন ও গৃহস্থালি কাজেও বেশি বেশি হাত লাগাতে শুরু করেন। মেলিসা তখন একজন গৃহকর্মী নিয়োগ দেন। সেই কর্মী তিন ঘণ্টা শিশুটিকে রাখতেন। ফলে সেই সময়ে মেলিসা আবারও ফ্রিল্যান্সিং লেখালেখির কাজে সময় ব্যয় করতে শুরু করেন। এরপর মেলিসার স্বামী হঠাৎ করেই চাকরি হারান। তখন দুজনের ভূমিকা একদম উল্টে যায়। এই ঘটনায় তাঁর স্বামীও বুঝতে পারেন, ১২ ঘণ্টার বেশি সন্তানের জন্য সময় দেওয়া কাজ হিসেবে কতটা কঠিন। সন্তান জন্মের আগে তাঁরা যতটা ভেবেছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন।
নারীর কাজের মূল্যায়ন নিয়ে গবেষণা করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে নারীর কর্মসংস্থানের পথে প্রধান সমস্যা হচ্ছে পারিবারিক ও সামাজিক বাধা। এ ক্ষেত্রে প্রথমত, মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে বা বেসরকারি পর্যায়ে উন্নত শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। অন্যদিকে নারীরা দক্ষতায়ও পিছিয়ে আছেন। ভালো কাজ বা প্রাতিষ্ঠানিক কাজ পেতে হলে নারীদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। সে জন্য সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
তবে একটি ব্যাপারে সবাই একমত। তা হলো, পরিবার ও সমাজের মনোভাব না বদলালে নারীর পক্ষে কাজ করা কঠিন। আর পুরুষকেও ঘরের কাজে হাত লাগাতে হবে। ঘরের কাজে যে পুরুষের হাত লাগাতে হয়, সেই মনোভাব তৈরি করাই আমাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ।