এলডিসি থেকে উত্তরণ

উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে করোনার বাধা

  • তিনটি সূচকের বাইরে করোনার প্রভাবও মূল্যায়ন হবে।

  • উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ।

  • বাণিজ্য-সুবিধার মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়ানোর জন্য লবিং।

স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পথে এখন করোনা-বাধার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে সুপারিশ করবে কোন কোন দেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দেওয়া যায়।

মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা—এই তিন সূচকের দুটিতে আগের তিন বছরে ধারাবাহিকতা থাকলেই কোনো এলডিসিকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দেওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ করা হয়। তবে এবারে ওই তিন সূচকের বাইরে করোনার প্রভাবও মূল্যায়ন করা হবে। ১৪ সেপ্টেম্বর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিডিপি। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

সিডিপি জানিয়েছে, ওই তিন সূচকের পাশাপাশি করোনার প্রভাব মূল্যায়নে এলডিসিগুলোর ওপর একটি সমন্বিত সমীক্ষা করা হচ্ছে। সংস্থাটির মতে, করোনার কারণে স্বল্পোন্নত দেশগুলো বেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এসব দেশের স্বাস্থ্যসেবা বেশ দুর্বল। তাই তারা করোনা রুখতে হিমশিম খাচ্ছে। করোনার মতো আঘাত মোকাবিলা করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতায় বেশ দুর্বলতা আছে। নিয়ম অনুযায়ী, বাংলাদেশ একবার এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে আর এলডিসিতে ফিরে যেতে পারবে না।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দেওয়ার সুপারিশ করতে পাঁচটি দেশকে বাছাই তালিকায় রেখেছে সিডিপি। আগামী বছরের ২২-২৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় ত্রিবার্ষিক সভায় বিষয়টি মূল্যায়ন করবে সিডিপি। ওই তালিকায় বাংলাদেশও আছে। অপর চারটি দেশ হলো নেপাল, মিয়ানমার, লাওস ও তিমুর লেসেথো। এর মধ্যে নেপাল ও তিমুর লেসেথো ২০১৮ সালেই সুপারিশ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সিডিপি ওই দুই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই না হওয়ায় সুপারিশ করেনি। অবশ্য নেপাল তখনো ভূমিকম্পের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

এদিকে ২০১৮ সালে সিডিপির ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে তিনটি সূচকের তিনটিতেই নির্ধারিত মান অর্জন করে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার শর্ত পূরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। পরের তিন বছরে এসব সূচকের ধারাবাহিকতা দেখে এখন চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দেওয়ার সুপারিশ করার কথা সিডিপির। এখানেই শেষ নয়। সিডিপি আগামী বছর সুপারিশ করলেও বাংলাদেশকে আরও তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চূড়ান্ত স্বীকৃতি দেওয়া হবে জাতিসংঘের ২০২৪ সালের সাধারণ অধিবেশনে।

আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ সংস্থা সিডিপি চূড়ান্ত সুপারিশ করবে কোন কোন দেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সিডিপির মূল্যায়নের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দেশের দৃষ্টিভঙ্গির ওপরও নির্ভরশীল। করোনা সংকটের কারণে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার প্রক্রিয়া আরও কিছুদিন পিছিয়ে দেবে নাকি উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর এলডিসি হিসেবে পাওয়া সুবিধার মেয়াদ ৫-৬ বছর বাড়ানোর চেষ্টা করবে, এটা পুরোপুরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এখন দেখার বিষয় সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়।

চলতি মাসের মাঝামাঝি এলডিসি থেকে উত্তরণবিষয়ক টাস্কফোর্সের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ করবে। সেই সঙ্গে করোনার কারণে বাণিজ্য-সুবিধার মেয়াদ আরও কয়েক বছর বাড়াতে দর-কষাকষির সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। যেমন এলডিসি থেকে উত্তরণ হলেও ২০২৭ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) শুল্কমুক্ত বাণিজ্য-সুবিধা মিলবে। সেটির মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বৃদ্ধির চেষ্টা করা হবে। এ ছাড়া দাতাদের কাছ থেকে স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার সুবিধা অব্যাহত রাখার তদবিরও করা হবে।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম সম্প্রতি বলেন, ‘করোনার কারণে অর্থনীতিতে ধাক্কা লেগেছে, এটি সত্য। তবে ভয়ের কিছু নেই। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের আগে বড় ধরনের বন্যা বা খরা না হলে আমরা তিনটি সূচকেই উত্তীর্ণ হব।

করোনায় যা হয়েছে

করোনার কারণে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, দেশে করোনার আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালের শেষে দারিদ্র্যের হার কমে সাড়ে ২০ শতাংশে নেমেছিল। কিন্তু করোনার কারণে নতুন করে লাখ লাখ মানুষ গরিব হয়ে গেছে। বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় দারিদ্র্য বৃদ্ধির চিত্র উঠে এসেছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) বলেছে, করোনার কারণে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪৩ শতাংশ হয়েছে। আরেক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির হিসাবে এই হার ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার প্রভাবে তরুণদের বেকারত্ব ২৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। করোনার আগে এই হার ছিল ১২ শতাংশের মতো।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের মানবসম্পদ সূচকে আগের চেয়ে পিছিয়েছে বাংলাদেশ। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের একজন শিশু উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে তার সম্ভাবনার ৪৬ শতাংশ বাস্তবায়ন করতে পারে, যা ২০১৮ সালে ছিল ৪৮ শতাংশ।

সূচকে পরিবর্তন হবে না

এবার সিডিপি সুখবর দিয়েছে। বলেছে, তিনটি সূচকের মানের কোনো পরিবর্তন করা হবে না। সূচকগুলোর মান ২০১৮ সালের মতোই থাকবে। ২০১৮ সালে সিডিপির মূল্যায়নে অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে বাংলাদেশ পেয়েছিল ২৫ পয়েন্ট। এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে এ সূচকে ৩২ পয়েন্ট বা এর নিচে থাকতে হবে।

মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ বা এর বেশি পয়েন্ট পেতে হবে। বাংলাদেশের রয়েছে ৭২ দশমিক ৮ পয়েন্ট। মাথাপিছু আয় সূচকে ১ হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার থাকতে হবে। ২০১৮ সালের হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২৭২ ডলার।