জ্বালানি তেল

উত্তোলন বাড়াচ্ছে না ওপেক, মূল্য আরও বৃদ্ধির শঙ্কা

বৃহত্তম তেল ক্রেতাদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও রপ্তানিকারকদের জোট ওপেকসহ রাশিয়া এ ব্যাপারে এককাট্টা যে তেল উত্তোলন বাড়ানো যাবে না।

জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েই চলেছে। কদিন পরপরই দামের নতুন রেকর্ড হচ্ছে। ইতিমধ্যে দাম বেড়ে সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। তার জেরে বাংলাদেশের বাজারে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তেলের এ উচ্চ মূল্যের কারণে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।

অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ—সবাই এখন কমবেশি একই কথা বলছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যালয় হোয়াইট হাউস সোজাসাপটা বলে দিয়েছে, দাম বৃদ্ধির দায় নিতে হবে ওপেকসহ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোকে। মূলত এরা তেল উত্তোলন বৃদ্ধি করতে চায় না বলেই পাঁচ মাস ধরে তেলের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। বিশ্বের বৃহত্তম তেল ক্রেতাদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও ওপেকসহ রাশিয়া এ ব্যাপারে এককাট্টা যে তেল উত্তোলন বাড়ানো যাবে না। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে হয়তো কৌশলগত রিজার্ভ বা সংরক্ষণাগার থেকে বাজারে জ্বালানি তেল ছাড়তে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের একজন কর্মকর্তা সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘চাহিদা ও সরবরাহের গড়বড়ের কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া যেন ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে। কিন্তু ওপেকসহ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো এখন নিজেদের সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সংকট নিরসনে রাজি নয়।’

কয়েক বছর ধরেই তেলের বাজারে মন্দা চলছিল। করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। বিধিনিষেধের কারণে চাহিদা হঠাৎ চাহিদা ব্যাপকভাবে কমায় গত বছরের এপ্রিলে জ্বালানি তেলের দাম মাইনাস ৩৭ ডলারে নেমে যায়। কিন্তু সেখান থেকে পরিস্থিতির অনেকটাই উত্তরণ ঘটেছে। করোনাভাইরাসের একাধিক ঢেউ চলে গেছে। ইউরোপ ছাড়া আর প্রায় সবখানেই ভাইরাস এখন নিয়ন্ত্রণে। ফলে পূর্ণগতিতে চলছে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার। বস্তুত গত বছরের শেষ দিকে যখন বিশ্ব প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে শুরু করে, তখন থেকেই তেলের দাম বাড়ছে। এখন ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ৮১ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ১২০ ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের বিষয়ে আমরা সব পর্যায়ে আলোচনা করেছি। বিশ্বাস করি, এ মুহূর্তে ঠিক কাজটিই করছি আমরা।
প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন সালমান, জ্বালানিমন্ত্রী, সৌদি আরব

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি তেল আমদানি করে চীন। তারপর ভারত। করোনার পর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ায় এ দুটি দেশ গত কয়েক মাস টানা তেল আমদানি বাড়িয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে চীন কয়লা ছেড়ে তেলের ব্যবহার বাড়াচ্ছে। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে চীনে অনুষ্ঠেয় শীতকালীন অলিম্পিক উপলক্ষে দেশটি বেইজিংয়ে দূষণ কমাতে চায়।

ওপেক ও যুক্তরাষ্ট্রের রশি–টানাটানি

বাজারে কী পরিমাণ তেল আসবে বা মোট কী পরিমাণ তেল উত্তোলন করা হবে, সে সিদ্ধান্ত নেয় ওপেক। মহামারির শুরুতে চাহিদা কমে গেলে ওপেকও তেল উৎপাদন কমায়। এখন চাহিদা বাড়লেও তারা উত্তোলন বাড়াচ্ছে না, শিগগির বাড়ানোর লক্ষণও নেই। সে জন্যই তেলের দাম বাড়তি।

সৌদি আরবের জ্বালানিমন্ত্রী প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন সালমান সিএনএনকে বলেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের বিষয়ে আমরা সব পর্যায়ে আলোচনা করেছি। বিশ্বাস করি, এ মুহূর্তে ঠিক কাজটিই করছি আমরা।’

২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচন। এ পরিস্থিতিতে বাইডেন প্রশাসনের হাতে একটিই অস্ত্র আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তা হলো কৌশলগত তেল সংরক্ষণাগারের দরজা খুলে দেওয়া। ৭১ কোটি ৪০ লাখ ব্যারেল ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এ সংরক্ষণাগার বিশ্বের বৃহত্তম ব্যাকআপ। টেক্সাস ও লুইজিয়ানার উপকূলজুড়ে মাটির দুই থেকে চার হাজার ফুট নিচে এ সংরক্ষণাগার। কেবল মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ সংরক্ষণাগারের তেল বাজারে ছাড়ার নির্দেশ দিতে পারেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ওপেকের এ রশি–টানাটানিতে বাজারে আরও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে বলে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা।

অর্থনৈতিক প্রভাব

কৃষি, পরিবহন, বিদ্যুৎ, কারখানা—সবখানেই জ্বালানি ব্যবহৃত হয়। ফলে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে সবকিছুর উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। এমনিতেই বিশ্বে এখন জাহাজ পরিবহনে বিঘ্ন ঘটার জন্য সরবরাহ সংকট চলছে। কাঁচামালের স্বল্পতায় ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। পিছিয়ে যাচ্ছে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার। এ পরিস্থিতিতে জ্বালানির লাগাতার মূল্যবৃদ্ধিতে চাহিদায় ভাটা পড়তে পারে বলে অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা। উন্নত দেশগুলোতে সরকার মানুষকে সরাসরি নগদ সহায়তা দিয়েছে। তাদের হাতে নগদ অর্থের ঘাটতি নেই। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনগণের জন্য সরকারের তেমন কিছু নেই।

কোভিডের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি তাদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হতে পারে বলেই আশঙ্কা।