ডলার–সংকটের কারণে ব্যাংকে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে হিমশিম খাচ্ছেন আমদানিকারকেরা। তাতে প্রায় সব ধরনের আমদানি পণ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ কারণে উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারিজ) আমদানি। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলা আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) একই সময়ের তুলনায় ৬৭ শতাংশ কমে গেছে। ঋণপত্র খোলা কমে যাওয়ার পাশাপাশি কমেছে ঋণপত্র নিষ্পত্তির হারও।
শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়া মানে শিল্পে নতুন বিনিয়োগ কমে যাওয়া। উৎপাদনও তাতে কমবে। যার সবচেয়ে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানে। কারণ, শিল্পে বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থানও তৈরি হবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে মাত্র ১৪১ কোটি ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৪২৫ কোটি ডলার। সেই হিসাবে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলা কমেছে ৬৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ২০২০ সালে করোনার কারণে দেশে শিল্পের বিনিয়োগ স্থবির হয়ে গিয়েছিল। করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ার পর পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়, তাতে শিল্পে উৎপাদন ও বিনিয়োগ উভয়ই বেড়ে যায়। এ জন্য ব্যবসায়ীরা ২০২১ ও ২০২২ সালের প্রথমার্ধে বিপুল পরিমাণ মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করেছিল। আর ২০২২ সালের শেষার্ধে এসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা দেখা দেয়। যার প্রভাব এসে পড়ে বাংলাদেশেও। তাতে ব্যাংক খাতে ডলার–সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। এ কারণে বিলাস পণ্যসহ আমদানির ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। তাতে নিত্যপণ্য ছাড়া অন্যান্য পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কমবেশি সব আমদানিকারক চাপে পড়েছেন। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কের খাতিরে ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে কিছুটা বাড়তি সুবিধা পেলেও মাঝারি ও ছোট আমদানিকারকেরা ঋণপত্র খুলতে হিমশিম খাচ্ছেন।
দেশে যেসব শিল্প খাতে নিয়মিতভাবে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয়, তার প্রায় প্রতিটি খাতেই ঋণপত্র খোলা কমে গেছে। ভারী ও বৃহৎ শিল্প খাতের মধ্যে বস্ত্র খাতে ৭৭ শতাংশ ও তৈরি পোশাক খাতে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলা ৬৭ শতাংশ কমে গেছে। এ ছাড়া চামড়াশিল্পে ৫৬ শতাংশ, পাটশিল্পে ৫৮ শতাংশ, ওষুধশিল্পে ৪০ শতাংশ, মোড়কজাত শিল্পে ৭৭ শতাংশ ও অন্যান্য শিল্প খাতে ঋণপত্র খোলা কমেছে ৬৬ শতাংশ।
গত জুলাই-জানুয়ারি সময়কালে বস্ত্র খাতে মাত্র ৯ কোটি ও তৈরি পোশাক খাতে ৪২ কোটি ডলারের যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। এ ছাড়া ওষুধশিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৭ কোটি ডলারের। চামড়া, পাট ও মোড়কজাত শিল্পে যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলা এক কোটি ডলারও পার হয়নি। তবে অবশিষ্ট অন্যান্য সব শিল্প খাতে অবশ্য মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ১০৮ কোটি ডলারের ঋণপত্র খুলেছেন আমদানিকারকেরা।
বাংলাদেশে আমদানি হওয়া মূলধনি যন্ত্রপাতির বড় অংশই ব্যবহৃত হয় রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কয়েক মাস ধরে তৈরি পোশাকের নতুন ক্রয়াদেশ কম। এ কারণে এ খাতে নতুন বিনিয়োগে একধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। বিনিয়োগ নেই অন্যান্য খাতেও। এ ছাড়া জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও সংকটের কারণেও ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন উদ্যোক্তারা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ব্যাংকগুলো কোনো ঋণপত্র খুলছে না। ডলার–সংকটের কারণ দেখিয়ে পুরোনো ঋণপত্র নিষ্পত্তিতেও গড়িমসি করছে। এ ধরনের পরিস্থিতি নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের পথে বড় বাধা। ভারী শিল্পে প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু যন্ত্রপাতি হালনাগাদ করতে হয়। সেটি না হলে উৎপাদন ব্যাহত হয়। আবার কিছু ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রয়াদেশ পেতেও নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজনের বাধ্যবাধকতা থাকে। তাই মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তির হার আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ৭ শতাংশ কমে গেছে। আবার শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলাও কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলা কমেছে ২৭ শতাংশ। অর্থাৎ, ভারী শিল্পে বিনিয়োগের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন শিল্প খাতে উৎপাদনও কমছে। তাতে কাঁচামাল কম লাগছে।
শুধু যে ভারী শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলা কমেছে তা–ই নয়, বিবিধ শিল্পের যন্ত্রপাতির কলকবজা বা যন্ত্রাংশ আমদানির ঋণপত্র খোলাও কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় জাহাজের ডিজেল ইঞ্জিন, কম্পিউটার যন্ত্রাংশ, মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশ, বাইসাইকেলের বিভিন্ন অংশ, পাওয়ার টিলার ও ইলেকট্রনিকস যন্ত্রাংশের মতো পণ্যের ঋণপত্র খোলা ৪৪ শতাংশ কমে গেছে। গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এ ধরনের যন্ত্রাংশ আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ২৫৬ কোটি ডলারের। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৪২ কোটি ডলারে। একই সময় এসব পণ্য আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তিও কমেছে ২৩ শতাংশ।
ব্যাংকাররা বলছেন, আমদানির ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের ঋণপত্র খুলতে গেলে এখন বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের ঋণপত্র খোলা হলে তা আটকে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার ডলার–স্বল্পতার কারণে অনেক ব্যাংক বড় অঙ্কের ঋণপত্র খোলা সীমিত করেছে। ফলে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলা কমে গেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনা–সংকটের পর দেশে বড় ধরনের বিনিয়োগ হয়েছে। সাধারণত দেখা যায়, এক বছর যদি বেশি বিনিয়োগ হয়, পরের দু-এক বছর বিনিয়োগ একটু কমে যায়। সব সময় বিনিয়োগের চিত্র একই থাকে না। এ ছাড়া এখন বৈশ্বিক সংকট চলছে, তাই বিনিয়োগকারীরা বাড়তি ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। সে জন্য মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলা কমে গেছে।’
তবে এ পরিস্থিতি যাতে দীর্ঘদিন না থাকে, সে জন্য সরকারকে এখনই উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনকার বাস্তবতায় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমলেও আপাতত বড় সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা কম। তবে দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে এ অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ বাজার চাহিদার সঙ্গে বিষয়টি জড়িত। তাই এ ব্যাপারে অবহেলা করলে চলবে না। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।’