উদ্যোক্তা

সোহেল চৌধুরীর বেশি দামের ‘সুস্বাদু মাছ’

অন্য মৎস্য খামারিরা যেখানে মাছ বিক্রি করতে বাজারে গিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছে ধরনা দেন, সেখানে সোহেল চৌধুরী নিজের খামারেই বসে থাকেন। ব্যবসায়ীরা তাঁর খামারে এসে মাছ কিনে নেন। কারণ, ভালো খাবার দেওয়ায় তাঁর খামারে উৎপাদিত মাছের স্বাদ বেশি হয়। ফলে সোহেলের মাছের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

নিজের খামারে মাছের খাবার দিচ্ছেন সোহেল চৌধুরী
ছবি: প্রথম আলো

লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার বিদেশফেরত সোহেল চৌধুরীকে মাছ বিক্রির জন্য মাছ ব্যবসায়ীদের কাছে বা হাটবাজারে যেতে হয় না; বরং ব্যবসায়ীরাই তাঁর কাছে জেনে নেন কবে তিনি মাছ তুলবেন এবং সে অনুযায়ীই তাঁরা এসে মাছ কিনে নেন। কিন্তু সোহেল চৌধুরীর মাছের এত চাহিদা কেন? সেই উত্তর জানা গেল তাঁর মাছের খামারে গিয়ে, আর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে।

হতাশা থেকে মাছের ব্যবসা

স্থানীয় সরকারি আলিমুদ্দীন ডিগ্রি কলেজ থেকে ডিগ্রি, অর্থাৎ স্নাতক পাস করার সময় থেকেই সোহেল চৌধুরী তাঁর বাবার বইয়ের দোকানে বসতেন। কিন্তু বইয়ের চাহিদা তো বেশি থাকে বছরের প্রথমে, যখন স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের নতুন ক্লাস শুরু হয়। বাকি সময়ে বইয়ের ব্যবসা তেমন জমে না। এ রকম অলস সময়ে কী করা যায়, সেই চিন্তা থেকে সোহেলের মাথায় আসে মাছের ব্যবসা করার। ব্যস, মাছের কয়েকটি খামার ঘুরে নিজেদের জমিতে ছোট পরিসরে খামার করেন। শুরুতেই লাভের মুখ দেখেন। কিন্তু এরই মধ্যে বিদেশে যাওয়ার বাসনা জাগে মনে। ২০০৩ সালের দিকে দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়ার জন্য ধারদেনা করে এক দালালকে সাত লাখ টাকা দেন সোহেল। তিনি বলেন, ‘দালাল মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে ঘুরিয়ে আবার দেশে এনে ছেড়ে দেন। এতে হতাশ হয়ে পড়ি। তখন আবার সীমিত পরিসরে মাছের ব্যবসা শুরু করি। দুই লাখ টাকার মাছ ছেড়ে এক বছরে দুই লাখ টাকা আয় হয়। সেই টাকা আবার মাছের ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করি। একসময় হাতে আরও টাকা এল। তা দিয়ে ধারের ছয় লাখ টাকা পরিশোধ করলাম।’

২০১০ সালে সরকারিভাবে বৈধ উপায়ে দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়ার সুযোগ পান সোহেল। প্রায় ১০ বছর দক্ষিণ কোরিয়ায় থাকার পরে ২০২০ সালের শেষ দিকে দেশে ফেরেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় মাছের পরিপাটি খামার দেখার পাশাপাশি অনলাইনেও দেশ-বিদেশের মৎস্য খামারের কার্যক্রম সোহেল দেখেছেন। এতে উদ্বুদ্ধ হয়েই হাতীবান্ধা উপজেলার বাউরা ইউনিয়নে ৬০ বিঘার একটি বড় খামার পাঁচ লাখ টাকায় ভাড়া নেন। সেখানে আত্মীয়দের দিয়ে মাছ ছাড়ার ব্যবস্থা করেন তিনি। দেশে ফিরে নিজেই পুরোদমে খামারের কাজে নেমে পড়েন। দুই বছরে ভালো ফল পেয়ে ব্যবসার পরিধি আরও বাড়ান।

উন্নত ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার

সোহেলের সঙ্গে হাতীবান্ধা মহিলা কলেজের পাশে তাঁর একটি মাছের খামারে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমি ব্যবসার শুরুতে দেখেছি, আশপাশের অনেকে এই ব্যবসা করলেও মাছকে ভালো খাবার দেন না। অনেকে মুরগির বিষ্ঠা খেতে দেন। সেই মাছ বাজারে পাঠান, কিন্তু নিজেরা খান না। তখন আমি ঠিক করলাম, আমি মাছকে ভালো ও স্বাস্থ্যকর খাবার দেব, যাতে সেই মাছ আমার পরিবারও খেতে পারে।’ সোহেল বলেন, ‘মৎস্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী আমি মাছের পরিচর্যা করি। ভুট্টা, চালের কুঁড়া, ধানের ভুসি, সবুজ ঘাস ও সঠিক মাত্রায় ভিটামিন দিই। এ ধরনের প্রতি বস্তা খাবারে আমার প্রায় দেড় হাজার টাকা খরচ হয়। তবে দেখলাম, এতে মাছের স্বাদ ভালো হচ্ছে, বাজারেও চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে জন্য আশপাশের মাছচাষিদের আমি এ ধরনের খাবার দিতে উৎসাহিত করি। কিন্তু বেশি লাভের আশায় তাঁরা আমার কথা কানে তুললেন না। তাঁরা ৮০ থেকে ৯০ টাকা (প্রতি বস্তা) দামের মুরগির বিষ্ঠা দেন। কেউ কেউ তো ইউরিয়া সারও দেন, যা ক্ষতিকর।’

মাছের চাহিদা বাড়ছে

আলাপকালে হাতীবান্ধার মৎস্য ব্যবসায়ীরা প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা নিজেরাই সোহেলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, কখন তিনি কী মাছ তুলবেন। সেই অনুযায়ী তাঁরা খামারে এসে মাছ কিনে নেন। ভবানীপুর এলাকার ব্যবসায়ী ফজলার রহমান বলেন, ‘২৫ বছর ধরে এই ব্যবসা করছি। সোহেল ভাইয়ের মাছ খেয়ে দেখি স্বাদে বেশ ভালো। পরে বাজারে নিয়ে গেলে ক্রেতারাও তাঁর মাছের প্রশংসা করলেন। সে জন্য আমি তাঁর খামারের মাছ নিয়ে বিক্রি করি।’ ফজলার বলেন, ‘অন্য খামারিরা বাজারে এসে আমাদের মাছ দিয়ে যান। কিন্তু সোহেলের মাছের বেলায় ভিন্ন। নিজেরা তাঁর খামারে গিয়ে কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেশি দিয়ে আমরা মাছ কিনে আনি। কারণ, এলাকায় তাঁর মাছের আলাদা চাহিদা তৈরি হয়েছে।’

হাতীবান্ধার অন্যতম খাবারের দোকানদার মহির মিয়া বলেন, ‘আমি দুপুর ও রাতে সোহেলের মাছ পরিবেশন করি। বেশ কিছু সরকারি-বেসরকারি অফিস থেকেও খাবারের অর্ডার আসে। সেখানে সোহেল চৌধুরীর মাছ দিই আমি। কারণ, ক্রেতারা এই মাছের স্বাদে সন্তুষ্ট। কেউ কেউ মাছের উৎসও জানতে চান।’

সোহেল চৌধুরী জানান, এখন তিনি ছয়টি বড় খামারে মাছের চাষ করছেন। সব মিলিয়ে ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন তিনি। সোহেল বলেন, ‘মানুষ ভালো কিছু খাবে, স্বাস্থ্যসম্মত মাছ খাবে, এই ভাবনা সব সময় আমার মাথায় থাকে। সেটি নিশ্চিত রাখার চেষ্টা করি।’

মাছের খামার করার সময় একবার একটি তিন একরের জলাশয় পরিষ্কার করার প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু জলাশয়টি পরিষ্কার না করে সেখানে ৪৫০টি বোয়াল মাছ ছাড়েন সোহেল। এতে বোয়াল মাছগুলো খুব হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে বেশ ভালো দামেই সেসব মাছ বিক্রি করেন তিনি। এভাবে একটি পুকুরে চিতল চাষ করেও সফলতার মুখ দেখেছেন সোহেল।