নতুন আয়কর আইনে বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব জানিয়ে রিটার্ন জমা দিতে হবে। পুরোনো ফরমে রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে না। এবারের রিটার্নে আয়-ব্যয়ের হিসাবটি অবশ্যই ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত হতে হবে।
আয়কর নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন না এমন করদাতা খুঁজে পাওয়া কঠিন। করের হিসাবনিকাশ, কাগজপত্র সংগ্রহ, রিটার্ন ফরম পূরণ করা—এসব নিয়ে তাঁদের চিন্তার যেন শেষ নেই।
আর নভেম্বর মাস এলে সেই চিন্তা আরও কয়েক গুণ বেড়ে যায়। শুরু হয়েছে নভেম্বর মাস, রিটার্ন জমার মৌসুম। নতুন আয়কর আইন অনুসারে, নভেম্বরের পর রিটার্ন জমা দিলে কোনো করছাড় মিলবে না, উল্টো বাড়তি কর দিতে হবে। তাই এবার রিটার্ন জমার গুরুত্ব আরও বেড়েছে।
নতুন আয়কর আইনে বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব জানিয়ে রিটার্ন জমা দিতে হবে। পুরোনো ফরমে রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে না। এবারের রিটার্নে আয়-ব্যয়ের হিসাবটি অবশ্যই ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত হতে হবে। এই সময়ের মধ্যে আপনার কত টাকা আয়, কোথায় বিনিয়োগ করলেন, সেই ভিত্তিতেই কর হিসাব করতে হবে।
কর দেওয়ার এই মৌসুমে কীভাবে রিটার্ন তৈরি ও জমা দেবেন, তা জেনে নিতে পারেন। এবার মনে রাখবেন, বার্ষিক পাঁচ লাখ টাকার বেশি আয় এবং ৪০ লাখ টাকার বেশি সম্পদ থাকলেই সম্পদের বিবরণী ও জীবনযাত্রার বিবরণী জমা দিতে হবে।
দেশে বর্তমানে প্রায় ৯০ লাখ কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএনধারী আছেন। তাঁদের মধ্যে প্রতিবছর ৩০ লাখের মতো রিটার্ন জমা দেন। অনেকে রিটার্ন নিজেই পূরণ করেন। আবার অনেকে আইনজীবীর সহায়তায় রিটার্ন তৈরি করেন।
প্রতিবছরই আয়কর রিটার্ন জমায় বাজেটে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। চলতি অর্থবছরে করদাতাদের জন্য সুখবর হলো—ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করা হয়েছে। নারী করদাতা ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সী করদাতাদের জন্য চার লাখ টাকা; তৃতীয় লিঙ্গের করদাতা ও প্রতিবন্ধী করদাতাদের ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা; গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা করদাতার ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত।
করমুক্ত আয়সীমা অতিক্রম করলে ন্যূনতম করের পরিমাণ আগের মতোই রাখা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম সিটির করদাতাদের পাঁচ হাজার টাকা; অন্য সিটির করদাতাদের জন্য চার হাজার টাকা এবং অন্য এলাকার করদাতাদের ন্যূনতম কর তিন হাজার টাকা। সারচার্জে ধনীদের এবার ছাড় দেওয়া হয়েছে। তিন কোটি টাকার পরিবর্তে চার কোটি টাকার সম্পদ থাকলেই সারচার্জ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
আবার কোনো করদাতার বার্ষিক আয় পাঁচ লাখ টাকার কম হলে এক পাতার রিটার্ন ফরম পূরণ করলেই চলবে। এই ফরম এনবিআরের ওয়েবসাইটে আছে। এই ফরমে সব মিলিয়ে ১৬ ধরনের তথ্য দিতে হবে। এগুলো হলো নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, কর শনাক্তকরণ নম্বর, কর সার্কেল, কর অঞ্চল, করবর্ষ, আবাসিক মর্যাদা, মুঠোফোন নম্বরসহ যোগাযোগের ঠিকানা, আয়ের উৎস, মোট পরিসম্পদ, মোট আয়, আরোপযোগ্য কর, কর রেয়াত, প্রদেয় কর, উৎসে কাটা করের পরিমাণ (যদি থাকে), এই রিটার্নের সঙ্গে প্রদত্ত কর ও জীবনযাপন ব্যয়।
করের হিসাব করার সময় কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে। যেমন কোন কোন আয় পুরোপুরি করমুক্ত; আবার কোন ধরনের আয়ে নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত কর অব্যাহতি সুবিধা মেলে। নতুন আয়কর আইনে এমন ২২টি খাত চিহ্নিত করা হয়েছে।
খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সরকারি পেনশন তহবিল থেকে করদাতার গৃহীত বা বকেয়া পেনশন; সরকারি আনুতোষিক তহবিল থেকে প্রাপ্ত ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত; পেনশনার সেভিংস সার্টিফিকেট থেকে সুদ হিসেবে গৃহীত অর্থ বা অর্থের সমষ্টি; বিদেশে উপার্জিত কোনো আয়; ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট ফান্ড, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড, ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড, ইউরো প্রিমিয়াম বন্ড, ইউরো ইনভেস্টমেন্ট বন্ড, পাউন্ড স্টার্লিং ইনভেস্টমেন্ট বন্ড বা পাউন্ড স্টার্লিং প্রিমিয়াম বন্ড থেকে প্রাপ্ত করদাতার আয়; শর্ত সাপেক্ষে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ‘কৃষি থেকে আয়’; পুরস্কারের অর্থ; তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ২৭ ধরনের আয়।
আয়-ব্যয়ের কিছু প্রমাণপত্র রিটার্ন জমার সময় দিতে হয়। যেসব কাগজপত্র লাগবে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বেতন খাতের আয়ের দলিল, সিকিউরিটিজের ওপর সুদ আয়ের সনদ, ভাড়ার চুক্তিপত্র, পৌরকরের রসিদ, বন্ধকি ঋণের সুদের সনদ, মূলধনি সম্পদের বিক্রয় কিংবা ক্রয়মূল্যের চুক্তিপত্র ও রসিদ, মূলধনি ব্যয়ের আনুষাঙ্গিক প্রমাণপত্র, শেয়ারের লভ্যাংশ পাওয়ার ডিভিডেন্ড ওয়ারেন্ট, সুদের ওপর উৎসে কর কর্তনের সনদ।
আবার কিছু খাতে বিনিয়োগ করলে কর কমে যায়। সেগুলোর কাগজপত্রও লাগবে। যেমন জীবন বিমার কিস্তির প্রিমিয়াম রসিদ, ভবিষ্য তহবিলে চাঁদার সনদ, ঋণ বা ডিবেঞ্চার, সঞ্চয়পত্র, শেয়ারে বিনিয়োগের প্রমাণপত্র, ডিপোজিট পেনশন স্কিমে (ডিপিএস) চাঁদার সনদ, কল্যাণ তহবিলে চাঁদা ও গোষ্ঠী বিমার কিস্তির সনদ, জাকাত তহবিলে দেওয়া চাঁদার সনদ।
এক দশক ধরে প্রতিবছর রিটার্ন জমার মৌসুমে এনবিআরের আয়কর বিভাগের ব্যবস্থাপনায় সারা দেশে কর মেলা হয়। কিন্তু কোভিড শুরুর পর সেই মেলা বন্ধ হয়ে যায়। এবারও কর মেলা হবে না। তবে প্রতিটি কর অঞ্চলে মেলার মতো করসেবা দেওয়া শুরু হয়েছে। নভেম্বর মাস জুড়েই দেশের ৩১টি কর অঞ্চলের ৬৪৯টি সার্কেল কার্যালয়ে এই সেবা দেওয়া হবে।
সেখানে রিটার্ন জমার পাশাপাশি রিটার্ন ফরম পূরণে সহায়তা মিলবে। আবার রিটার্ন জমার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে রিটার্ন জমার প্রাপ্তি স্বীকারপত্রও পাওয়া যাবে। এ ছাড়া ই-রিটার্ন জমা দিতে আগ্রহী করদাতাদের জন্য আলাদা বুথ থাকবে।
কেউ যদি ই-টিআইএন নিতে চান, তা–ও নিতে পারবেন না। এ ছাড়া নতুন আয়কর সম্পর্কে যে কোনো তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে থাকবে তথ্যকেন্দ্র।
নতুন আয়কর আইনে রিটার্ন জমার সময় বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। তাই ৩০ নভেম্বরের মধ্যেই রিটার্ন দিতে হবে। কিন্তু কোনো কারণে রিটার্ন দিতে না পারলে, নানা ধরনের কর অব্যাহতি সুবিধা পাওয়া যাবে না। যেমন যাতায়াত, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন খাতে করছাড় পাওয়া যায়। আবার সঞ্চয়পত্র, শেয়ারসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেও কর রেয়াত পাওয়া যায়। ৩০ নভেম্বরের পর রিটার্ন জমা দিলে এসব করছাড় পাওয়া যাবে না। এতে করদাতাদের করের পরিমাণ বেড়ে যাবে।
সব মিলিয়ে ৪৩টি সরকারি–বেসরকারি সেবা নিতে আগের মতো রিটার্ন জমার রসিদ লাগবে। যেসব সেবা নিতে রিটার্ন জমার রসিদ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ২০ লাখ টাকার বেশি ঋণ আবেদন করলে; ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনলে; গাড়ির মালিক হলে, ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার ক্ষেত্রে; সরকার থেকে ১৬ হাজার টাকার বেশি বেতন পেলে; কোনো কোম্পানির পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার হলে; ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য হলে; কারও সন্তান বা পোষ্য ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করলে; অস্ত্রের লাইসেন্স নেওয়ার ক্ষেত্রে; উপজেলা, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হলে।
এ ছাড়া নির্দিষ্ট ব্যক্তির পক্ষ থেকে সিটি করপোরেশন এলাকায় বাড়িভাড়া বা লিজ গ্রহণের সময় বাড়ির মালিকের; নির্দিষ্ট ব্যক্তির পক্ষ থেকে সেবা বা পণ্য গ্রহণকালে ওই পণ্য বা সেবা সরবরাহকারীর; ট্রাস্ট, তহবিল, ফাউন্ডেশন, এনজিও, ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী সংস্থা, সোসাইটি ও সমবায় সমিতির ব্যাংক হিসাব খুলতে ও চালু রাখতে; স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি ও কার্টিজ পেপারে ভেন্ডর বা দলিল লেখক হিসেবে নিবন্ধন, লাইসেন্স বা তালিকাভুক্তি করতে বা বহাল রাখতে; রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে এমন গঠিত কর্তৃপক্ষ বা অন্য সিটি করপোরেশন, পৌরসভায় অনুমোদনের জন্য ভবন নকশার আবেদন দাখিলকালে রিটার্ন জমার রসিদ লাগবে।