পয়লা বৈশাখে ইলিশ নিয়ে মাতামাতি কমেছে, এবার বিক্রিও কম

পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে এবার ইলিশের বেচাবিক্রি তুলনামূলক কম। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে
ছবি: জাহিদুল করিম

প্রতিবছর পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে পান্তাভাত আর আলুভর্তার সঙ্গে খাবারের তালিকায় ইলিশ মাছ ভাজা রাখতেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। তবে ধীরে ধীরে সেই প্রবণতা থেকে সরে এসেছেন তাঁরা।

সর্বশেষ দুই বছর আগে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে তাঁরা ইলিশের পরিবর্তে দেশীয় পুঁটি মাছভাজা খেয়েছেন। আর গত বছর রমজানের মধ্যে হওয়ায় ইফতারির পরে মিষ্টিজাতীয় খাবার দিয়ে বৈশাখ বরণ করেছেন শিক্ষার্থীরা।

‘পয়লা বৈশাখের আয়োজনে ইলিশ থাকতেই হবে, সেই প্রবণতা এখন আর নেই,’ প্রথম আলোকে বলছিলেন ওই বিভাগের শিক্ষক উজ্জ্বল কুমার মণ্ডল। ‘এই মাছের দাম অনেক বেশি। ফলে সবার পক্ষে তা জোগান দেওয়া সম্ভব নয়; বরং আমাদের বিভাগে ইলিশের পরিবর্তে যে পুঁটি মাছ দিয়ে আয়োজন করা হয়েছে, তা সবাই পছন্দ করেছেন।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের এই চিত্র ব্যতিক্রম কোনো উদাহরণ নয়। বর্তমানে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানেও বৈশাখ আয়োজনে ইলিশ খাওয়া নিয়ে কম মাতামাতি দেখা গেছে।

আর এর ফলাফল দেখা গেছে বাজারেও। কয়েক বছর আগে পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে ইলিশের যে আকাশচুম্বি দাম ওঠে, তেমনটা আর দেখা যায় না।

মাছ ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এর কিছু কারণের কথা উল্লেখ করেন। এক. বর্তমানে বেশ কয়েকটি অভয়াশ্রমে ইলিশ মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকা। দুই. রমজান মাসের মধ্যে বৈশাখের আয়োজন। তিন. বর্তমান মূল্যস্ফীতি ও বাজারে ইলিশের বাড়তি দাম।

মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা
ইলিশ উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে জাটকা সংরক্ষণের জন্য মার্চ-এপ্রিল—এই দুই মাস কয়েকটি ইলিশ অভয়াশ্রমে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। বরিশাল, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, শরীয়তপুর ও পটুয়াখালীর ইলিশ অভয়াশ্রমসংশ্লিষ্ট নদ-নদীগুলো এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকে।

এ সময় এসব এলাকায় ইলিশ ধরা, বহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে অন্য অঞ্চলে (যেমন চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার) ইলিশ ধরা ও বিক্রি করা যায়।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ক্রেতাদের মধ্যে বরিশাল ও চাঁদপুর অঞ্চলের ইলিশের চাহিদা বেশি থাকে। কিন্তু ওই অঞ্চলের অভয়াশ্রমগুলোয় ইলিশ মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকায় বাজারে ইলিশের সরবরাহ কম। পাশাপাশি দাম অনেক বেশি। ফলে ঢাকার বাজারে এখন যেসব ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে, তার বেশির ভাগই কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের।

রাজধানীর বাজারগুলোতে বর্তমানে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ইলিশের প্রাধান্য। তবে বরিশাল ও চাঁদপুর অঞ্চলের ইলিশও আছে। আজ কারওয়ান বাজারে

চাঁদপুরে ইলিশের বেচাকেনা বেশি হয় বড় স্টেশন হাটে। এখানকার ইলিশ ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন ব্যাপারী জানান, বর্তমানে ইলিশ ধরা নিষেধ। তাই আগে থেকে সংরক্ষণ করা কিছু ইলিশ অনেকে বিক্রি করছেন। চাঁদপুরে এক কেজি ওজনের প্রতিটি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। আর ৮০০ গ্রামের কাছাকাছি ওজনের ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ টাকার আশপাশে। তবে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ইলিশের দাম কিছুটা কম বলে জানান তিনি।

আলাউদ্দিন ব্যাপারী বলেন, রোজার মধ্যে বাংলা নববর্ষ পড়ে যাওয়ায় আগের তুলনায় ইলিশের বিক্রি কম হচ্ছে। অনেকে আবার বেশি দাম শুনে কিনছেন না বা কম কিনছেন।

রাজধানীর বাজারগুলোতেও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ইলিশের প্রাধান্য দেখা গেছে। এসব ইলিশ দেখতে কিছুটা লম্বাটে। খেতে চাঁদপুর ও বরিশাল অঞ্চলের ইলিশের তুলনায় কম সুস্বাদু। এ কারণে এ ধরনের ইলিশের দামও তুলনামূলক কম থাকে।

কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা আজ ১ কেজি ওজনের পদ্মার (চাঁদপুর, বরিশাল) ইলিশ মাছ ১ হাজার ৮০০ টাকার আশপাশে বিক্রি করছেন। আর ৮০০ গ্রামের পদ্মার ইলিশ বিক্রি হচ্ছে দেড় হাজার টাকায়।

অন্যদিকে কারওয়ান বাজারে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আসা এক কেজি ওজনের প্রতিটি ইলিশ আজ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায়। আর ওই এলাকার ৮০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকায়।

কারওয়ান বাজারের মাছ বিক্রেতা মো. সুমন ইসলাম বলেন, ‘রোজার কারণে বড় ধরনের বৈশাখী অনুষ্ঠান আয়োজন তেমন নেই। এ কারণে ক্রেতা কম থাকায় ইলিশের অর্ডার আগের মতো পাচ্ছি না।’

ঢাকার কারওয়ান বাজারে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আসা এক কেজি ওজনের প্রতিটি ইলিশ আজ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায়

বাজারের পাশাপাশি ইলিশের বিক্রি কমেছে সুপারশপগুলোতেও। সুপারশপ স্বপ্নের নির্বাহী পরিচালক সাব্বির হাসান জানান, চলতি বৈশাখে ইলিশ বিক্রির পরিমাণ গত বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ কমেছে। বিপরীতে মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে ২৫ শতাংশ। পাশাপাশি করপোরেট ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বৈশাখের আয়োজন কম থাকায় ইলিশের ক্রয়াদেশও কম আসছে।

এই সুপারশপে বর্তমানে ছোট ইলিশ বেশি বিক্রি হচ্ছে। এর বিপরীতে বড় ইলিশের বিক্রি কমেছে ৭০ শতাংশ। স্বপ্নের বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে সাধারণত বরগুনা অঞ্চল থেকে ইলিশের একটা বড় সরবরাহ আসে। সেটা এ বছর কম। সেখানে কক্সবাজারের ইলিশই বেশি বিক্রি হচ্ছে।

ধ্বংস হতে পারে ইলিশের জেনারেশন
ইলিশ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদীকেন্দ্র চাঁদপুরের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিসুর রহমান। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহ সদর দপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন।

আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দশক আগেও দেশে ইলিশ নিয়ে অতটা মাতামাতি ছিল না। তবে জাতীয় মাছ ইলিশ নিয়ে দিন দিন মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। ইলিশকে জিআই পণ্য করা, এর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানা, ইলিশ নিয়ে সরকারের ইতিবাচক প্রচারণা ইত্যাদি এর পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা আজ ১ কেজি ওজনের পদ্মার (চাঁদপুর, বরিশাল) ইলিশ মাছ ১ হাজার ৮০০ টাকার আশপাশে বিক্রি করছেন

পয়লা বৈশাখে আলাদা করে ইলিশ খাওয়ার প্রবণতাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেন না এই ইলিশ গবেষক। আনিসুর রহমান বলেন, ‘বছরের একটা নির্দিষ্ট দিনে হঠাৎ ইলিশের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় নদী থেকে অপরিণত ইলিশ ধরার পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে ইলিশের একটা জেনারেশন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।’

আনিসুর রহমান আরও বলেন, বাড়তি চাহিদার কারণে বাজারে ইলিশের দামও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। তবে মানুষ এখন পয়লা বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার প্রবণতা থেকে সরে আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, ইলিশ রক্ষা করতে ও এর সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে বৈশাখে বেশি পরিমাণে ইলিশ খাওয়ার প্রবণতা থেকে সরে আসতে হবে।