ভাবমূর্তি ফেরাতে এবার নিরীক্ষক নিয়োগ দিল আদানি গোষ্ঠী

গৌতম আদানি
ছবি: এএফপি

ভাবমূর্তি ফেরাতে এবার স্বাধীন একটি নিরীক্ষা সংস্থাকে দিয়ে নিরীক্ষা করাবে আদানি গোষ্ঠী। সে জন্য বিশ্বখ্যাত নিরীক্ষাপ্রতিষ্ঠান গ্র্যান্ট থর্নটনকে নিয়োগ দিয়েছে তারা। গত ২৪ জানুয়ারি হিনডেনবার্গ প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর এটাই আদানি গোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

গত সপ্তাহেই আদানি গোষ্ঠী বলেছিল, তারা আইনি বিষয়-আশয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে লেনদেন ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলো স্বাধীনভাবে খতিয়ে দেখার কথা ভাবছে। আর সে লক্ষ্যেই গ্র্যান্ট থর্নটনের এই নিয়োগ।

আদানি গোষ্ঠীর বেশ কয়েকটি কোম্পানির অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা করবে গ্র্যান্ট থর্নটন। ইকোনমিক টাইমস এক অজানা সূত্রের বরাতে বলেছে, মূলত, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আদানি গোষ্ঠীর লেনদেন খতিয়ে দেখবে থর্নটন।

এ বিষয়ে গ্র্যান্ট থর্নটন ও আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সফল হয়নি ইকোনমিক টাইমস।

গতকাল সোমবার বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে আদানি গোষ্ঠী দাবি করেছে যে তাদের হিসাবের খাতা (ব্যালান্স শিট) যথেষ্ট পোক্ত। ব্যবসা বিস্তারের পরিকল্পনা থেকেও পিছপা হচ্ছে না তারা। তার জন্য অর্থের সংস্থানও করা আছে। শেয়ারহোল্ডারদের রিটার্ন দেওয়ার বিষয়েও তারা আত্মবিশ্বাসী। সংস্থা পরিচালনার বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষ কঠোরভাবে মেনে চলে বলেও দাবি তাদের।

কিন্তু ভারতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোও নড়েচড়ে বসেছে। ভারতের বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো গতকাল এটা নিশ্চিত করেছে যে তারা হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদন খতিয়ে দেখছে। এ ছাড়া প্রতিবেদন প্রকাশের আগে–পরে বাজারের তৎপরতাও খতিয়ে দেখবে তারা।

এদিকে গতকাল সপ্তাহের প্রথম দিনে আদানি গোষ্ঠীর তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দরপতন অব্যাহত ছিল। গতকাল আদানি এন্টারপ্রাইজেসের শেয়ারের দর ৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ কমেছে। আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন ৫ দশমিক ২৫, অম্বুজা সিমেন্ট ৫ দশমিক ১৭, এসিসির ৩ দশমিক শূন্য ৬ আর আদানি উইলমার ও এনডিটিভির দর পড়েছে ৫ শতাংশ করে। কমেছে আদানি পাওয়ারেরও দর। গত ৫২ সপ্তাহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে আদানি ট্রান্সমিশন, আদানি গ্রিন এনার্জি ও আদানি টোটাল গ্যাসের শেয়ারের দর।

ভারতের লোকসভাতেও আদানি গোষ্ঠী নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। গতকাল লোকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে দেশটির কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী ভাগবত কারাড বলেন, আদানিদের বিভিন্ন কোম্পানিতে পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বিমা কোম্পানির মোট ৩৪৭ দশমিক ৬৪ কোটি রুপি বিনিয়োগ আছে, যা মোট বিনিয়োগের শূন্য দশমিক ১৪ শতাংশ। কোম্পানিগুলো হলো ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্স, নিউ ইন্ডিয়া অ্যাসিওরেন্স, ইউনাইটেড ইন্ডিয়া ইনস্যুরেন্স, ওরিয়েন্টাল ইনস্যুরেন্স ও জেনারেল ইনস্যুরেন্স করপোরেশন। আর এলআইসি বিনিয়োগ করেছে ৩৫ হাজার ৯১৭ দশমিক ৩১ কোটি রুপি, মোট তাদের মোট বিনিয়োগের শূন্য দশমিক ৯৭৫ শতাংশ। এলআইসি অবশ্য সেই হিসাব (২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত) আগেই জানিয়েছে।

অন্যদিকে, ভারতের স্টেট ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক আদানি গোষ্ঠীকে কত ঋণ দিয়েছে, সে প্রশ্নের জবাব অবশ্য ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী দেননি। কারাডের যুক্তি, রিজার্ভ ব্যাংকের আইন অনুযায়ী, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাকে কত ঋণ দিয়েছে, তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা যায় না, এ নিয়ে বিধিনিষেধ আছে।

এ নিয়ে শুরু হয়েছে সমালোচনা। ভাগবত কারাডের কথার জবাবে টুইটারে কংগ্রেস সাংসদ মণীশ তিওয়ারির কটাক্ষ, মন্ত্রী শীর্ষ ব্যাংককে ঢাল করে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। বিনিয়োগের তথ্য শুধু শতাংশের হিসাব না দেখিয়ে পূর্ণাঙ্গ আর্থিক হিসাবও দেখানো উচিত।

২০২০ সালেও গৌতম আদানির সম্পদমূল্য ছিল ৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন বা ৮৯০ কোটি ডলার। এরপর উল্কার গতিতে বাড়তে থাকে সম্পদমূল্য। করোনাভাইরাস মহামারিতে বিশ্বের অন্য অনেক শতকোটিপতির মতো গৌতম আদানির সম্পদও ফুলেফেঁপে ওঠে। ২০২১ সালে তাঁর সম্পদমূল্য দাঁড়ায় ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে। আর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি যখন মুকেশ আম্বানিকে ছাড়িয়ে এশিয়ার তৃতীয় শীর্ষ ধনী হন, তখন তাঁর সম্পদমূল্য ছিল ৮ হাজার ৮৫০ কোটি ডলার।

আদানির এই নাটকীয় উত্থানকে লক্ষ্য করেই তোপ দাগিয়েছে হিনডেনবার্গ রিসার্চ।

কী আছে হিনডেনবার্গ প্রতিবেদনে
হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনটিতে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তার মোদ্দাকথা হলো, কারচুপির মাধ্যমে ধনী হয়েছেন গৌতম আদানি। তাঁর মালিকানাধীন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দর বাড়িয়েছে। এভাবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে।

এই প্রতিবেদন প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই আদানির বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দর হু হু করে কমছে, যার ধারা আজও অব্যাহত। সব মিলিয়ে আদানি গোষ্ঠীর তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধন কমেছে ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলারের বেশি।

কমেছে গৌতম আদানির ব্যক্তিগত সম্পদমূল্যও। ফোর্বসের তালিকা অনুযায়ী, ২৪ জানুয়ারি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার দিন গৌতম আদানির সম্পদমূল্য ছিল ১১৯ বিলিয়ন বা ১১ হাজার ৯০০ কোটি ডলার, আজ সকালে যা ছিল ৫৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৪৪০ কোটি ডলার।

২৪ জানুয়ারির পর মাঝে এক দিন ব্যতীত প্রতিদিনই আদানির সম্পদমূল্য কমেছে।