অর্থবছরের প্রথম চার মাস দেশের প্রধান তিনটি খাদ্যশস্যের আমদানি কমেছে ৩৭ শতাংশ। ঋণপত্র খুলতে বিলম্ব হচ্ছে, আমদানির সহজ উৎসও কমেছে।
চাহিদা পূরণে চলতি অর্থবছরে অন্তত এক কোটি টন গম ও চাল আমদানির প্রয়োজন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। অথচ খাদ্যশস্য আমদানি কমছে। কেবল চাল ও গমই নয়, কমেছে ডাল আমদানিও। এই তিন পণ্যই হচ্ছে দেশের প্রধান তিন খাদ্যশস্য। এমন সময়ে এসব পণ্যের আমদানি কমছে, যখন আগামী বছরে বৈশ্বিক খাদ্যসংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ।
২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ১০ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আমদানি বরং আগের তুলনায় কমেছে। কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা ডলার–সংকটে ব্যাংকে চাহিদানুযায়ী ঋণপত্র খুলতে না পারার কথা জানিয়েছেন।
ডলারের দর নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় অনেকেই ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। পাশাপাশি উৎস দেশ সীমিত হয়ে যাওয়ার প্রভাব আমদানিতে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নেবে। আর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য আমদানি কমেছে।জি এম আবুল কালাম আজাদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রায় চার মাসে (১ জুলাই থেকে ২১ অক্টোবর) চাল, ডাল ও গম আমদানি হয়েছে ১৫ লাখ ৩৪ হাজার টন। গত অর্থবছরে একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ২৪ লাখ ৪৬ হাজার টন। এক বছরের ব্যবধানে আমদানি ৯ লাখ ১২ হাজার টন বা ৩৭ শতাংশ কমেছে। শুধু গত অর্থবছরই নয়, গত সাত অর্থবছরে একই সময়ে এবারের আমদানি হয়েছে সবচেয়ে কম।
খাদ্যশস্য আমদানিকারকের সংখ্যাও কমেছে। পাম তেল, সয়াবিন তেল ও চিনিতে যেমন গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, খাদ্যশস্যে তা নেই। ছোট থেকে বড় ব্যবসায়ীরা খাদ্যশস্য আমদানি করেন। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ৩৪৮টি প্রতিষ্ঠান খাদ্যশস্য আমদানি করেছে। গত অর্থবছরে একই সময়ে ছিল ৪৯৩টি প্রতিষ্ঠান। অন্তত ১৪৫টি প্রতিষ্ঠান এবার আমদানি করেনি, যাদের বড় অংশই ছোট প্রতিষ্ঠান। আমদানির সহজ উৎস ভারতের বিধিনিষেধের কারণে এবং ডলার–সংকটে ব্যাংকে ঋণপত্র খুলতে না পারায় ছোট ব্যবসায়ীরা আমদানি করতে পারছেন না বলে জানা গেছে।
ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক শীর্ষ চার ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলছেন, ডলারের হঠাৎ উত্থানে আমদানি দায় শোধ করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা বাড়তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। প্রতি ডলার ৮৬ টাকা দরে পণ্য এনে গত কয়েক মাসে ১০০ থেকে ১১২ টাকা দরে ডলার কিনে আমদানি দায় মিটিয়েছেন তাঁরা। অনেকে আমদানি দায় পরিশোধের সময় পিছিয়ে দিয়েছেন। এখন ব্যাংকগুলো ডলার জোগানে নিশ্চয়তা দেওয়া ছাড়া সহজে ঋণপত্র খুলতে চায় না। বড় গ্রুপগুলো ঋণপত্র খুলতে পারলেও ছোট ব্যবসায়ীরা বেশি সমস্যায় পড়ছেন। ভোগ্যপণ্যের ঋণপত্রও যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে ঋণপত্র খুলতে বিলম্ব হচ্ছে।
আমদানি কমলেও এখনো বড় সংকট হবে না। তবে আগামী দিনে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খোলায় সহযোগিতার জন্য ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।মো. শফিউল আথহার তাছলিম, টি কে গ্রুপের পরিচালক
ব্যাংকের ৩০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের আমদানি ঋণপত্র তদারকি এবং ডলার–সংকটে আমদানি কমার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নেবে। আর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য আমদানি কমেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ চলতি অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন কমার আভাস দিয়েছে। অক্টোবরে প্রকাশিত সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, এবার ৩ কোটি ৫৬ লাখ টন চাল উৎপাদন হতে পারে, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ২ লাখ টন কম। তাতে চাহিদা মেটাতে ১২ লাখ টন চাল আমদানির দরকার হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে সংস্থাটি।
চালের বাজার ইতিমধ্যে অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। বাজার স্বাভাবিক করতে সরকার নিজে আমদানি করছে, পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও কম শুল্কে আমদানির বরাদ্দ দিচ্ছে। চলতি অর্থবছরে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে এ পর্যন্ত সরকারিভাবে ১৪ লাখ ৩০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে পাঁচ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি হয়েছে। আর বেসরকারি খাতে কম শুল্কে ৪২৯ প্রতিষ্ঠানকে ১৫ লাখ টন চাল আমদানির বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।
সরকারি খাতে আমদানি শুরু হলেও বেসরকারি খাতে আমদানি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (২১ অক্টোবর পর্যন্ত) সরকারি-বেসরকারি খাতে চাল আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৩ হাজার টন। অথচ অক্টোবরের মধ্যেই ১১ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল বাজারজাতের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল সরকার। গত অর্থবছরে একই সময়ে সাড়ে পাঁচ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছিল।
আমদানি কমে যাওয়া খাদ্য নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের। এখন সরকার নিজস্ব উদ্যোগে আমদানি করে মজুত বাড়ানো দরকার। যাতে কোনো গুজবে প্রাপ্যতার অনিশ্চয়তা তৈরি হয়ে পণ্যের দাম না বাড়ে।মোস্তাফিজুর রহমান, বিশেষ ফেলো, সিপিডি
গমের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি করে পূরণ করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ চলতি অর্থবছরে দেশে ৭০ লাখ টন গম আমদানির আভাস দিয়েছে। গত কয়েক বছরে দেশে গড়ে বার্ষিক ৬৪ লাখ টন গম আমদানি হচ্ছে। এনবিআরের হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে গম আমদানি হয়েছে ৯ লাখ ৮৪ হাজার টন। গত অর্থবছরে একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ১৫ লাখ ৩০ হাজার টন। এ হিসাবে আমদানি ৩৬ শতাংশ কমেছে।
দেশে সাধারণ আমিষযুক্ত গমের প্রধান উৎস ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন। যুদ্ধের পর দেশ দুটি থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে পড়ে। ভারত গত ১৩ মে থেকে রপ্তানি বন্ধ করায় সহজ উৎসও হাতছাড়া হয়েছে। অবশ্য এ মাস থেকে সরকারি খাতে রাশিয়া থেকে এবং বেসরকারি খাতে ইউক্রেন থেকে গম আমদানির তিনটি জাহাজ এসে পৌঁছেছে। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় দেশ দুটির মধ্যে চুক্তির আওতায় এখন গম আমদানি হচ্ছে। আগামী নভেম্বরে এই চুক্তির মেয়াদ পেরিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে রাশিয়া এই চুক্তি থেকে সরে আসতে চাইছে। চুক্তির মেয়াদ না বাড়লে আবার এই বাজার বন্ধ হয়ে পড়বে।
আরেক খাদ্যশস্য ডাল আমদানিও কমেছে। চাহিদানুযায়ী উৎপাদন না হওয়ায় দেশে বছরে ১৩-১৪ লাখ টন ডাল আমদানি হয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ডাল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৪৬ হাজার টন। গত অর্থবছরে একই সময়ে আমদানি হয় ৩ লাখ ৬৯ হাজার টন।
জানতে চাইলে টি কে গ্রুপের পরিচালক মো. শফিউল আথহার তাছলিম প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি কমলেও এখনো বড় সংকট হবে না। তবে আগামী দিনে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খোলায় সহযোগিতার জন্য ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রতিবছর খাদ্যশস্য, ভোগ্যপণ্য, মসলা ও ভোজ্যতেলের কাঁচামাল তেলবীজ আমদানি বাড়ছে। এনবিআরের হিসাবে, এক দশক আগে ২০১২-১৩ অর্থবছরে খাদ্যশস্য, ভোগ্যপণ্য ও ভোজ্যতেল তৈরির বীজ আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল ৩৪৭ কোটি ডলার। এক দশকের ব্যবধানে তা ১৭৮ শতাংশ বেড়ে গত অর্থবছরে ৯৬৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। জাহাজভাড়া, ইনস্যুরেন্সসহ কাস্টমসের শুল্কায়ন মূল্যের হিসাবে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ মোট আমদানি ব্যয়ের ১১ শতাংশই যাচ্ছে ভোগ্যপণ্যে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি কমে যাওয়া খাদ্য নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের। এখন সরকার নিজস্ব উদ্যোগে আমদানি করে মজুত বাড়ানো দরকার। যাতে কোনো গুজবে প্রাপ্যতার অনিশ্চয়তা তৈরি হয়ে পণ্যের দাম না বাড়ে।
আবার বেসরকারি খাতে খাদ্যশস্য আমদানিতে যাতে অপ্রণোদনা তৈরি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। ঋণপত্র খোলায় কোনো সমস্যা না হয়, সে দিকটা দেখা উচিত। আগামী বোরো মৌসুমে খুবই সতর্ক থাকা উচিত, কোনো ঘাটতির কারণে যাতে উৎপাদন ব্যাহত না হয়। এসব বিষয় গুরুত্ব দেওয়া হলে সমস্যা হবে না।