আগেই বেড়ে থাকা নিত্যপণ্যের দাম কমার লক্ষণ নেই

রাজধানীর খিলগাঁও বাজারে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ব্রয়লার মুরগি কিনছিলেন স্থানীয় আমতলা এলাকার বাসিন্দা হোসেন উদ্দিন। আলাপকালে তিনি জানান, সাতজনের সংসারে তিনি ও তাঁর বড় ছেলে উপার্জনক্ষম।

বেসরকারি চাকরিজীবী এই দুজনের মোট আয় মাসে ৫০ হাজার টাকার মতো। কিন্তু এতেও তাঁদের খেয়ে–পরে চলতে কষ্ট হয়। সঞ্চয় তো দূরের কথা, সংসারের খরচ মেটাতে মাঝেমধ্যে ধারদেনাও করা লাগে।

হোসেন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে আমার আয়েই সংসারের খরচ মেটাতাম। করোনার পর থেকে কলেজপড়ুয়া ছেলেকেও কাজ শুরু করতে হয়েছে। তাতে পরিবারের আয় বেড়েছে। তবে এর মধ্যে দ্রব্যমূল্য এত বেড়েছে যে দুজনে আয় করেও সংসারের খরচ সামাল দিতে পারছি না। মাসের শেষে টাকা থাকে না, আজ টাকা ধার করে বাজারে এসেছি। বাসায় অতিথি, তবুও বাড়তি কেনার সুযোগ নেই।’

গত কয়েক মাস নিত্যপণ্যের বাজারে বড় কোনো সুখবর নেই। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকে বৈশ্বিক পণ্যবাজারে দামের উত্তাপ ছড়াতে থাকে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ে দেশের বাজারেও। এতে কয়েক দফা বাড়ে নিত্যপণ্যের দাম। এর মধ্যে দু-একটি বাদে অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে একটি জায়গায় স্থির হয়ে আছে। কমার লক্ষণ নেই। বাজার খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ।

গতকাল রাজধানীর খিলগাঁও, মালিবাগ ও রামপুরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মোটা চাল (স্বর্ণা ও চায়না ইরি) বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫২ থেকে ৫৪ টাকায়। মাঝারি মানের চালের দাম প্রতি কেজি ৫৮ থেকে ৬০ টাকা। সরু চাল মান ভেদে বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৮৫ টাকা পর্যন্ত। সরু চালের মধ্যে মিনিকেট ও নাজিরশাইলের বিক্রি বেশি। গত ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর থেকে সব ধরনের চাল প্রতি কেজিতে অন্তত ৫ থেকে ৮ টাকা বেড়েছে।

রামপুরা বাজারে রহমান রাইস স্টোরের মালিক মো. আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চালের দাম কমার আপাতত কোনো সংবাদ নেই। মাস দুয়েক ধরে দামটা প্রায় একই। বেশি দামের কারণে মানুষ চাল কেনা কমিয়ে দিয়েছে। এতে আমাদের ব্যবসায় মন্দাভাব দেখা দিয়েছে।’

চালের মতো আটার দামও উচ্চ মূল্যে এসে থেমে আছে। বিশ্ববাজারে গমের দাম কমে এলেও দেশের বাজারে আটার দাম এখনো বাড়তি। খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫৩ থেকে ৫৫ টাকায়। প্যাকেটজাত ২ কেজির আটার প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২৫ টাকায়। ২ কেজির প্যাকেটজাত এই আটার দাম এ বছরের শুরুতেও ৮০ থেকে ৮৫ টাকার মধ্যে ছিল।

গতকাল যে তিনটি বাজার ঘুরে দেখা হয়েছে, তার কোনোটিতে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে চিনি বিক্রি হতে দেখা যায়নি। ব্যবসায়ীরা জানান, সরকার খোলা চিনির দাম নির্ধারণ করেছে প্রতি কেজি ৮৪ টাকা। অথচ পাইকারি বাজারে গতকালও খোলা চিনি বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৮৭ টাকার আশপাশে। অন্যান্য খরচ বাদে ন্যূনতম লাভে বিক্রি করলেও ৮৮ টাকার নিচে বিক্রি করা সম্ভব নয়। এদিকে অভিযানের ভয়ে ব্যবসায়ীরা খোলা চিনি বিক্রি না করে প্রতি কেজি ৯৫ টাকা দরে প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি করছেন। এটা আগের দামের চিনি, বাজারে নতুন দামের প্যাকেটজাত চিনি আসেনি।

এদিকে গতকাল ঢাকার বাজারে সবজির দাম একটু বাড়তি দেখা গেছে। মান ভেদে প্রতি কেজি বেগুন ৭০ থেকে ৯০ টাকা, করলা ৭০ থেকে ৮০ টাকা, কাঁকরোল ৬০ থেকে ৭০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০ থেকে ৭০ টাকা, টমেটো ১০০ থেকে ১২০ টাকা ও কাঁচা মরিচ ৬০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছোট একটি বাঁধাকপি ও ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। শিম ১২০ থেকে ১৪০ টাকায়। শীতের আগাম এসব সবজির মধ্যে বাজারে আরও পাওয়া যাচ্ছে মুলা। প্রতি কেজি মুলা বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়।

বাংলাদেশ কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি মো. ইমরান মাস্টার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাস দুয়েক আগে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর সবজির উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কৃষকেরা আমাদের জানান, বাজারে সেটির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তবে শীতের সবজির সরবরাহ বাড়লে দাম কমে আসবে।’

এদিকে বাজারে ফার্মের মুরগির ডিম ও মাংসের দামও চড়া। প্রতি ডজন ফার্মের বাদামি রঙের ডিম এখন বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়। ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায়। তবে সোনালি মুরগির দাম কিছুটা কমে প্রতি কেজি ৩২০ টাকা থেকে নেমে এসেছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায়। মাঝে এসব পণ্যের দাম এক দফা বেড়ে আবার কমেছিল। এখন আবার সেই বাড়তি দামেই কিনতে হচ্ছে। রাজধানীতে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারগুলোতে ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের ব্যবহার বেশি হয়ে থাকে।

নিত্যপণ্যের দাম কমাতে সরকারি পদক্ষেপ আরও জোরদারের আহ্বান জানিয়ে কনজু৵মারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দাম বাড়লে কমার নজির এ দেশে খুবই কম। তবে অক্টোবরের পরে মূল্যস্ফীতি একটু কমে আসবে বলে আশা করা যায়।

কারণ, এ সময়ে নতুন ধান ওঠে; আবার শীতের সবজিও বাজারে আসতে শুরু করে। তবে সামগ্রিকভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিযোগিতা কমিশনের পদক্ষেপগুলো এগিয়ে নিতে হবে। ব্যবসার জন্য সরকার উৎসাহ দেবে ঠিকই, তবে সিদ্ধান্ত হতে হবে ভোক্তাবান্ধব।