চাল, ডাল, ভোজ্যতেলসহ সব নিত্যপণ্য এবং খাতা–কলমের দাম, বাসভাড়া, বাসাভাড়া—সবকিছুই বেড়েছে।
মোশাররফ হোসেন (৫৫) ঢাকার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে ছোট পদে চাকরি করেন। থাকেন মগবাজারের কাছে দিলু রোডে, ভাড়া বাসায়। একার আয়ে সংসার চলে না, তাই তাঁর স্ত্রী বাসায় ছোট ছোট কয়েকজন ছেলেমেয়েকে পড়ান। একমাত্র মেয়ে ইস্পাহানি স্কুলে পড়ে। বৃদ্ধা মা আছেন বাসায়। স্বামী-স্ত্রী মিলে আয় করেন ৪৫ হাজার টাকা।
দিলু রোডের এক মুদিদোকানে গতকাল সোমবার সকালে চাল, ডাল, লবণ, সয়াবিন তেল, মসলা, তরল দুধ ইত্যাদি কিনছিলেন মোশাররফ হোসেন। প্রথম আলোর প্রতিবেদক পরিচয় দিয়ে জিনিসপত্রের দাম কেমন—জানতে চাইলে বলেন, ‘এমন কোনো জিনিস নেই, যার দাম বাড়েনি।’
বাসা থেকে অফিসের দূরত্ব আধা কিলোমিটার। কথা হলো হাঁটতে হাঁটতেই। জানালেন, এ পথটুকু একসময় রিকশায় আসতেন। এখন আর সেই বিলাসিতা করেন না। কীভাবে সামলাচ্ছেন সব—এমন প্রশ্ন করতেই একটা হিসাব দেন মোশাররফ। জানান, ‘যাতায়াতের ভাড়া বাঁচাতে বাসাটা নিই অফিসের কাছে।
বাসাভাড়া ১৮ হাজার, বিদ্যুৎ বিল ও গ্যাস বিল আড়াই হাজার, চাল, ডালসহ মাসিক শুকনা বাজার ১০ হাজার, কাঁচাবাজার চার হাজার, মায়ের ওষুধ তিন হাজার, মেয়ের স্কুলের বেতন ও বই-খাতা মিলিয়ে ছয় হাজার টাকা খরচ হয়। সব মিলিয়ে খরচ ৪৩ হাজার ৫০০ টাকা। সামাজিকতা করার জন্য আর কিছু থাকে না। বিয়ের অনুষ্ঠানে কেউ দাওয়াত দিলে এড়িয়ে যাই।’
সীমিত আয়ের মানুষ ও চাকরিজীবীরা সবচেয়ে বেশি চাপে পড়েছেন। চিকিৎসা কিংবা অন্য কোনো বিপদ এলে তাঁরা খরচ করতে পারছেন না।গোলাম রহমান, সভাপতি, ক্যাব
পায়ে হেঁটে এবার যাই মগবাজার কাঁচাবাজারে। কথা হয় সবজি কিনতে আসা গৃহিণী হালিমা খাতুনের (৪৩) সঙ্গে। ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই বলে হতাশ তিনি। কী করবেন এখন—জানতে চাইলে বলেন, ‘এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে। রাতের বেলায় কারওয়ান বাজারে নাকি সস্তায় সবজি বিক্রি হয়। ওখানেই যাব।’
নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসপত্রের দামই যখন বাড়তি, মোশাররফ হোসেন ও হালিমা খাতুনের মতো সীমিত আয়ের মানুষেরা এভাবেই সামলাচ্ছেন তাঁদের পরিবার। তিন বেলা ডাল-ভাত খাওয়ার কষ্টেও আছেন অনেকে। নিম্নবিত্তরা খাদ্যতালিকা থেকে মাংস ও বড় মাছ বাদ দিয়েছেন। মধ্যবিত্তকেও বাজারের কষ্ট ছুঁয়ে যাচ্ছে। সরকারি হিসাব বলছে, দেশের মূল্যস্ফীতির হার এখন ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম, যা বেশি থাকাটাই যৌক্তিক।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
সরকার তাহলে কী করছে—এ নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘একশ্রেণির মানুষ কষ্টে আছেন, এটা ঠিক। এ কারণে এক কোটি মানুষের কাছে স্বল্পমূল্যে টিসিবির পণ্য বিক্রির কার্যক্রমটা চালু থাকবে। মানুষকে স্বস্তি দিতে বেতন-মজুরি বাড়ানোর দরকার। কিন্তু চাইলেই এটা পারা যায় না। ভোক্তাদের সাশ্রয়ী হওয়াই এখন উত্তম বিকল্প।’
ভাত খাওয়া তো কমাতে পারব না। আগে প্রতি বেলায় ভাতের সঙ্গে ডাল, ভাজি ও একটি তরকারির পদ থাকত। এখন তরকারির পদ কমেছে।আল মামুন
শুধু খাদ্যপণ্য নয়, যাতায়াতভাড়া প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বাসে উঠলেই আধা কিলোমিটারের রাস্তা হলেও ভাড়া ১০ টাকা। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে বাসে ওঠেন এক যাত্রী। তিনি যাবেন শাহবাগ। স্বল্প এ দূরত্বের জন্য বাসের হেলপার ভাড়া চান ১০ টাকা, কিন্তু যাত্রী দিতে চান ৫ টাকা। এ নিয়ে হাতাহাতি হয় বিকল্প পরিবহনের একটি বাসে।
এদিকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা মিটারে চলা বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগে। নিম্নবিত্ত মানুষ নিরুপায় হয়ে মাঝে মাঝে চুক্তিতে অটোরিকশায় চড়েন। সেই ভাড়া এখন প্রায় দ্বিগুণ। পথ যতটুকুই হোক, উঠলেই ১০০ টাকা। দুই থেকে তিন কিলোমিটার পথ যেতে হচ্ছে ২০০ টাকায়। আর সম্পন্ন মানুষ যাঁরা উবারের গাড়িতে চড়েন, গত দুই–তিন মাসে ভাড়া বেড়েছে গড়ে ১০ থেকে ২০ শতাংশ।
গতকাল এই প্রতিবেদক মোটরসাইকেলে বিমানবন্দর থেকে কারওয়ান বাজার আসতে ভাড়া গুনেছেন ২০০ টাকা, দুই মাস আগেও যা ছিল ১৭০ টাকা। মোটরসাইকেলচালক আবু সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে, বাড়তি ভাড়া চাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। দুই মাস আগেও প্রতি দিন ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকা আয় করতে পারতাম। এখন তা হাজার টাকার নিচে নেমেছে। আগের মতো যাত্রী পাওয়া যায় না।’ ফাঁকে গত সপ্তাহে বেড়েছে ৫৩ ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম। আবার বছর ঘুরলেই বাড়ছে বাড়িভাড়া।
সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট, ব্রাশ, রেজর, ফোম, খাতা, কলম-পেনসিল, রাবার, শার্পনার, ডিটারজেন্ট—এসব পণ্য কিনতেই বেশি দিতে হচ্ছে। বাজেট বাড়াতে হচ্ছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বড় আকারে লাক্স, মেরিল, লাইফবয় সাবানের দাম ছয় মাসের ব্যবধানে ১০ টাকা বেড়েছে। বড় আকারের লাক্স সাবানের দাম এখন ৭৫ টাকা। ৩৫০ গ্রামের সানসিল্ক শ্যাম্পুর দাম ৩০ টাকা বেড়ে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ১৫০ গ্রামের ক্লোজআপ ব্র্যান্ডের টুথপেস্ট বিক্রি হচ্ছে ১২৫ টাকায়। দাম বেড়েছে ৫ টাকা। আর সব ধরনের টুথব্রাশের দাম ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে।
নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা এখন আর সেলুনে গিয়ে শেভ করেন না। রেজর ও ফোমের দামও বেড়েছে। জিলেট ব্র্যান্ডের ৩৩০ মিলিলিটারের ফোম বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকায়। ছয় মাস আগে দাম ছিল ২৫৫ টাকা। জিলেটের ব্লু২ রেজরের দাম ১০ টাকা বেড়ে ৪০ টাকা হয়েছে। কাপড় কাচার জন্য গুঁড়া পাউডারের দামও কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে। এক কেজি রিন ১৬০ টাকা ও এক কেজি হুইল পাউডার ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সন্তানের পড়াশোনায় খরচ বাড়ছে। ১২০ পৃষ্ঠার খাতার দাম ৫ টাকা বেড়েছে। ৩০ টাকার নিচে আর কোনো খাতা মিলছে না। ১০ টাকার পেনসিল এখন ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার কলমের দাম ৫ টাকা থেকে শুরু। রাবার ও শার্পনারের দাম ২ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। ১০ টাকার নিচে মোটামুটি মানের রাবার মিলবে না।
রাজধানীর কাওলার মধ্যপাড়ায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাস করেন আল মামুন। তিনি উত্তরার দিয়াবাড়ির একটি প্যাকেজিং কারখানায় হিসাব বিভাগে কাজ করেন। কয়েক মাস আগেও কষ্টেসৃষ্টে চালাতে পারতেন তিনি। এখন আর পারেন না।
গতকাল কাওলা আমবাগানে এক চায়ের দোকানে বসে আল মামুন বলছিলেন, প্রতি মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা ধার করতে হয় তাঁকে। জানালেন, এক বছর ধরে টাকার অভাবে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করতে পারেননি। এ বিষয়ে আল মামুন বলেন, ‘ভর্তির সময় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লাগে। প্রতি মাসে বেতনও দিতে হবে। এদিকে ছোট মেয়েটার স্কুলের দেওয়ার সময় হয়ে এল। সব মিলিয়ে বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় আছি।’
সংসার চালাতে কোথায় খরচ কমাচ্ছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে আল মামুন বলেন, ‘ভাত খাওয়া তো কমাতে পারব না। আগে প্রতি বেলায় ভাতের সঙ্গে ডাল, ভাজি ও একটি তরকারির পদ থাকত। এখন তরকারির পদ কমেছে।’
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সীমিত আয়ের মানুষ ও চাকরিজীবীরা সবচেয়ে বেশি চাপে পড়েছেন। চিকিৎসা কিংবা অন্য কোনো বিপদ এলে তাঁরা খরচ করতে পারছেন না। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিন চলতে থাকলে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে।