অস্বাভাবিক দাম ঠেকাতে ভারত থেকে কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি দিয়েও কোনো লাভ হলো না। অনুমতি দেওয়ার দিন গত ২৫ জুন বাজারে যে কাঁচা মরিচের দাম ছিল ২৫০ টাকা কেজি, গতকাল শনিবার দেশে তা ৪৮০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে বেচাকেনা হয়েছে। অথচ এ ফাঁকে বাংলাদেশি মুদ্রায় ২১ টাকা কেজি দরের ভারতীয় কাঁচা মরিচও দেশে এসেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ উইং ৪৪ জনকে ১৭ হাজার ৯০০ টন অর্থাৎ ১ কোটি ৭৯ লাখ কেজি কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি (আইপি) দিয়েছে ২৫ জুন। কাস্টমসের তথ্য বলছে, এ থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠান সোনামসজিদ ও হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ৩৮ হাজার ৬৭১ কেজি কাঁচা মরিচ আমদানি করেছে ২৬ জুন।
দেখে নেওয়া যাক, ভারত থেকে কত দামে কাঁচা মরিচ আমদানি করা হয়েছে আর শুল্ক–কর ও মুনাফা যোগ করে দেশের বাজারে তার দাম কত পড়ছে। ঈদের ছুটির কারণে অনেকে আমদানি করতে পারেননি। তবে আজ পুরোদমে আমদানি শুরু হবে।
ঈদের ছুটির সময় আর কোনো কাঁচা মরিচ আমদানি হয়নি। তিন প্রতিষ্ঠানের গড় আমদানি খরচ পড়েছে ১৯ সেন্ট বা ২১ টাকা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলফাজউদ্দিন অ্যান্ড সন্স প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ আমদানি করেছে ২৪ সেন্ট বা ২৬ টাকা কেজি দরে। দিনাজপুরের হাকিমপুরের সততা বাণিজ্যালয়ের খরচ পড়েছে ২০ সেন্ট বা ২২ টাকা এবং বগুড়ার বি কে ট্রেডার্সের প্রতি কেজির খরচ পড়েছে ১৫ সেন্ট বা ১৬ টাকা।
কাস্টমস শুল্কায়ন করছে প্রতি কেজিতে ৩২ টাকা করে। আমদানি মূল্য ও শুল্ক–করসহ হিসাব করলে তা দাঁড়ায় ৫৩ টাকা। দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তর পরিবহন খরচ প্রতি কেজি ১০ টাকা ধরলে তা হয় ৬৩ টাকা। তিনটি হাত ঘুরে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা করে মুনাফা ধরলে আরও যোগ হয় ৩০ টাকা। মুনাফা আরও ৭ টাকা বাড়িয়ে ধরলেও কেজিতে তা ১০০ টাকার বেশি হয় না।
যদিও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যমের খবর, গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে সেখানেও মরিচের দাম বেড়েছে। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মরিচ বিক্রি হচ্ছে ২৫০–৪০০ রুপি দরে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গতকাল বগুড়ায় নতুন রোটারি বর্ষ উপলক্ষে বিভাগীয় শোভাযাত্রায় প্রধান অতিথি ছিলেন। এ সময় কাঁচা মরিচের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাঁচা মরিচ কৃষিজাত পণ্য। উৎপাদন কত হলো এবং দাম কেন বেড়েছে, তা কৃষি মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে।
আমদানির অনুমতি দিতে দেরি কেন
পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিতে কৃষি মন্ত্রণালয় যে গড়িমসি করেছিল, একই কাজ করেছে কাঁচা মরিচের ক্ষেত্রেও। এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য গতকাল কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক ও কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তারের মোবাইলে কয়েকবার চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। বিষয়বস্তু জানিয়ে খুদে বার্তা দিলেও কোনো জবাব দেননি তাঁরা।
পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়েছিল গত ১৪ মে। কৃষি মন্ত্রণালয় তা আমলে না নিয়ে পেঁয়াজের দাম যখন শত টাকা ছুঁই ছুঁই, তখন ৪ জুন পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতীয় পেঁয়াজ দেশে আসায় দাম কিছুটা কমেছে।
কাঁচা মরিচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিত্যপণ্য তালিকার মধ্যে পড়ে না। এটি কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন পণ্য। ঈদের আগে বাজারে কাঁচা মরিচের দাম যখন বাড়তে বাড়তে ১৫০, ২০০ ও ২৫০ টাকা কেজি হয়, তখনো কৃষি মন্ত্রণালয় আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়নি। কেজি ২৫০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর ঈদের তিন দিন আগে ২৫ জুন কাঁচা মরিচের আইপি দেওয়া হয়। এক দিন (২৬ জুন) মরিচ আসার পরই শুরু হয়ে যায় সরকারি ছুটি, যা গতকাল শেষ হয়।
আরও আগে কেন আইপি দেওয়া হলো না, এমন প্রশ্নের জবাবে উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ উইংয়ের পরিচালক মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের তো কৃষকের কথাও ভাবতে হয়। এটা ঠিক, আইপি আরও আগে দেওয়া গেলে কার্যকর বেশি হতো। ঈদের ছুটি পড়ে যাওয়ায় অনেকে আমদানি করতে পারেননি। তবে কাল (আজ রোববার) থেকে পুরোদমে আমদানি শুরু হবে এবং দামও কমে আসবে কাঁচা মরিচের।’
ঢাকার বাজার চিত্র
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে গতকাল ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে কাঁচা মরিচ ৪৮০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে কেনাবেচা হচ্ছে, যা ঈদের কয়েক দিন ছিল ৪০০ টাকার কম।
মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের খুচরা বিক্রেতা মো. মনসুর গত রাতে কারওয়ান বাজার থেকে প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) ২ হাজার ২০০ টাকা দরে কাঁচা মরিচ কিনেছেন। প্রতি কেজিতে খরচ পড়েছে ৪৪০ টাকা। এ মরিচ তিনি ৪৮০ টাকা দরে সকাল থেকে বিক্রি করেন।
একই বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান শুক্রবার কারওয়ান বাজার থেকে এক পাল্লা মরিচ কিনেছেন ২ হাজার ৫০০ টাকা দরে। গতকাল তিনি এই মরিচ বিক্রি করেন ৫৫০ টাকা দরে। লুৎফর রহমান বলেন, যে দামে কিনতে হয়েছে তার থেকে লোকসানে বিক্রি করা যায় না।
মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ ক্রেতারা মরিচ কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম করে মরিচ কিনছেন অনেকে। রাজধানীর কাঁঠালবাগানে কাঁচা মরিচ কিনতে আসা স্থানীয় বাসিন্দা রফিউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘হঠাৎ করেই মরিচের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে ১০০ গ্রাম কিনেছি। দাম কমলে বেশি করে কিনব।’
ফলন বিপর্যয়ও কি দায়ী
প্রথম আলোর বগুড়া প্রতিনিধি জানান, বগুড়ার মহাস্থান হাটে গতকাল এক কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি করে বগুড়া সদরের পীরগাছা গ্রামের কৃষক আবদুল আলিম (৫৫) পেয়েছেন ৪৮০ টাকা। ফড়িয়া-ব্যাপারিদের হাতবদল হয়ে ১২ কিলোমিটার দূরের বগুড়া শহরের ফতেহ আলী সবজির খুচরা বাজারে এক কেজি কাঁচা মরিচ কিনতে কৃষককে গুনতে হয়েছে গড়ে ৬৪০ টাকা।
মহাস্থান হাটে মরিচ বিক্রি করতে আসা তেলিহারা গ্রামের কৃষক শাহ আলম বলেন, ‘ম্যালা দিন থ্যাকে পত্তা আবাদ করিচ্চি। হামার জন্মের পর পত্তার এত দাম কোনু দিন পাইনি। গতবার এই সময় এক কেজি পত্তা বেচনু ৫০-৬০ টেকা দরত। সেই পত্তা আজ বেচিচ্চে ৪৮০ টেকা কেজি।’
বেড়া, পাবনা প্রতিনিধি জানান, সাঁথিয়া উপজেলা দেশের অন্যতম কাঁচা মরিচ উৎপাদনের এলাকা। রেকর্ডছোঁয়া দামের পেছনে ফলন বিপর্যয়কেই দায়ী করেছেন মরিচচাষি ও ব্যবসায়ীরা। হিসাব দিয়ে তাঁরা জানান, এক বিঘা মরিচের আবাদে খরচ হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এর সঙ্গে বর্গাচাষিদের জমির ভাড়া ধরলে হিসাবটা আরও বেশি। এবার প্রচণ্ড খরা হওয়ায় মরিচগাছগুলো কুঁকড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ফলন একেবারেই কম হয়েছে।
যশোর প্রতিনিধি জানান, জেলার ৫৯০ হেক্টর জমিতে মরিচের আবাদ হলেও প্রচণ্ড খরার কারণে উৎপাদন হয়নি যশোরে। সদর উপজেলার রহমতপুর গ্রামের আইনাল মণ্ডল বলেন, ‘৯ শতক জমিতে চাষ করেছি। মাঝে প্রচণ্ড খরায় খেত পুড়ে নষ্ট হয়েছে।’
প্রথম আলোর মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ঈদের আগের দিন মানিকগঞ্জে খুচরা বাজারে কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হলেও গতকাল ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হয়।