যুদ্ধে ক্ষতি বেশি কৃষি খাতে 

  • সরকার যদি ভর্তুকি না দিত তাহলে গ্রামাঞ্চলের ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হতো। 

  • অরক্ষিত জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে চাইলে সরাসরি টাকা দেওয়াই ভালো।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত ‘বিআইডিএস রিসার্চ অ্যালমানাক ২০২৩’ শীর্ষক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। গতকাল রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে দেশের কৃষি খাত। তবে সারে ভর্তুকি দিয়ে এই খাতের চিত্র বদলানো সম্ভব। যুদ্ধের কারণে দেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। সরকার যদি ভর্তুকি না দিত, তাহলে গ্রামের অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ লাখ মানুষের দারিদ্র্য হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তখন এসব মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হতো তাদের ‘ক্যাশ ট্রান্সফার’ বা সরাসরি টাকা দেওয়া। 

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল বুধবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ‘বিআইডিএস রিসার্চ অ্যালমানাক ২০২৩’ শীর্ষক সম্মেলনের একটি কারিগরি অধিবেশনে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। বিআইডিএসের গবেষক তাহরিন তাহরীমা চৌধুরী ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব: একটি সাধারণ ভারসাম্য বিশ্লেষণ’ শীর্ষক গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গবেষণার সহ-লেখক আংগা প্রদেশা। 

বাংলাদেশও যুদ্ধজনিত বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির চাপে পড়েছে। তবে সরকার ভর্তুকি দেওয়ার ফলে অনেক মানুষ দরিদ্র হওয়া থেকে রেহাই পেয়েছে। 

গবেষণাপত্র উপস্থাপনকালে তাহরিন তাহরীমা চৌধুরী বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এতে দেশের বাজারেও পণ্যের দাম বাড়ে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের কৃষি খাত। সে জন্য এই খাতের উৎপাদন ঠিক রাখতে সারে ভর্তুকি অব্যাহত রাখার সুপারিশ করা হয় এই গবেষণা প্রতিবেদনে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যে দামে খাদ্য কিনতে হচ্ছিল, তাতে সরকার যদি ভর্তুকি না দিত তাহলে নতুন করে গ্রামাঞ্চলের ৩০ লাখ মানুষ দরিদ্র হতো। অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর এই মানুষগুলোর আয়ের সিংহভাগই কৃষিকাজ থেকে আসে। সুতরাং বিরূপ পরিস্থিতিতে তাদের সুরক্ষা দিতে চাইলে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো সরাসরি টাকা পাঠানো বা ‘ক্যাশ ট্রান্সফার’। 

গবেষণায় বলা হয়েছে, দারিদ্র্য দূরীকরণে সরকারের পক্ষ থেকে গ্রামের অরক্ষিত মানুষদের ব্যাংক হিসাবে টাকা পাঠালে তা বিভিন্ন পণ্যে ভর্তুকি দেওয়ার চেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। কারণ, ভর্তুকি দেওয়া হলে সেই অর্থের উপকারভোগী হয় দেশের সবাই। অরক্ষিত জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে চাইলে সরাসরি টাকা দেওয়াই ভালো।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি পেট্রোলিয়াম ও সারের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনাও দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, সরকার এসব ক্ষেত্রে ভর্তুকি চলমান রাখায় নতুন করে অনেক মানুষ দারিদ্র্যের শিকার হননি। 

একই অনুষ্ঠানে তাহরিন তাহরীমা চৌধুরী ‘বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের কর্মনৈপুণ্যে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের নেতৃত্বাধীন কর্মপরিবেশ ব্যবস্থার প্রভাব’ শীর্ষক আরেকটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন। এতে তিনি বলেন, রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর দেশের তৈরি পোশাক খাতে কর্মপরিবেশের উন্নয়নে আমূল পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের তদারকি।

তবে কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নয়ন-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের লাভের পরিমাণ বাড়ানোর চেয়ে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে বেশি। যে কারখানার কর্মপরিবেশ ভালো, সেখানকার শ্রমিকেরা নিজেদের বেশি নিরাপদ বোধ করেন। ফলে তাঁদের কাজের গতি বাড়ে।

গবেষণায় উঠে এসেছে, কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত করলে তাতে অবশ্য লাভের অঙ্ক তেমন বাড়ে না, আবার প্রবেশাধিকারের সুবিধায়ও সেটির খুব ইতিবাচক প্রভাব পড়ে না।

একই অধিবেশনটিতে ‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের (এসএমই) জন্য টেকসই অর্থায়নের কৌশল: দুটি বিকল্প মডেল’ শীর্ষক আরেকটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। এটি উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন। 

মঞ্জুর হোসেন বলেন, দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে যে ঋণ দেওয়া হয়, সেটা শুধু ঋণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ওই সব প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগও নিতে হবে। সক্ষমতা বাড়াতে ব্যাংকগুলোকে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতার উদ্যোগ নিলে সেটা বেশি কার্যকর হবে। 

এ ছাড়া ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দেওয়া ও ঋণের তদারকির জন্য তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করা গেলে এই খাতে টেকসই অর্থায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে মত দেন তিনি। 

গবেষণাপত্রে আরও বলা হয়, এই খাতের জন্য টেকসই অর্থায়ন কৌশলে ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার মতো অর্থের সরবরাহ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে এটাও খুঁজে দেখতে হবে যে এই খাতের ভালো ঋণগ্রহীতা কারা।